দুর্নীতির ফাঁদ পাতা এই দেশে

কার্টুন: তুলি
কার্টুন: তুলি

দুর্নীতি একটি ব্যাপক শব্দ, বহুল অর্থে উচ্চারিত। দুর্নীতি ম্যাটেরিয়াল ও ইন্টেলেকচুয়াল। অনৈতিক সব কাজই দুর্নীতি। প্রচলিত অর্থে দুর্নীতি বলতে আমরা বুঝি অর্থনৈতিক দুর্নীতি। বাংলাদেশের সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র দীর্ঘ দিন ধরে গোটা জাতিকে উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বাংলাদেশকে গত দশকে পুনঃপৌনিকভাবে অবিরাম পাঁচবার বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। হালেও এ অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ দুর্নীতির সঙ্গে কতটুকু জড়িত? তাঁরা তো দিবানিশি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জীবিকা নির্বাহ করছেন। হিমালয়প্রমাণ দুর্নীতির কলঙ্কের তাঁরা কেন অংশীদার হবেন? তাঁরা তো কোনো দুর্নীতি করেন না। তাঁরা তো অস্ত্র আর মাদক ব্যবসা করেন না। তাঁরা তো নারী ও শিশু পাচার করেন না। হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং করেন না। এমএলএম ব্যবসার ফাঁদে ফেলে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করে অর্থের পাহাড় গড়েন না। লাইসেন্স ও সরকারি দলিল জাল করেন না। দেশের সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন না। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এজেন্ট হয়ে সরকারের সঙ্গে অসম চুক্তি করে যোগসাজশে জাতির অমূল্য সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেন না। শেয়ারবাজারে ধস নামিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেন না।
স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও বাংলাদেশ একটি পরনির্ভরশীল ও পশ্চাৎপদ দেশ। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর (অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা ও বাসস্থান) একটিরও ন্যূনতম সমাধান দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। যাপন করছে মানবেতর জীবন। সমাজে ধনী-নির্ধনের চরম বৈষম্য। ধনাঢ্যের ধন, সে তো রবিঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’র কাহিনি। গরিবের শেষ সম্বল বসতবাটির দুই বিঘা জমি জমিদারের চাই। চাই তাঁর বিশাল ‘বাগানবাড়িটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে আরও সমান করে টানার জন্য’।
দুর্নীতির সজ্ঞায় বলা যায়, ব্যক্তির সুবিধার জন্য সরকারি পদের অপব্যবহার। দুর্নীতির সঙ্গে স্বভাবতই জড়িত শাসনযন্ত্রে উঁচু মহলের নীতি-নির্ধারক কর্তাব্যক্তিরা, রাষ্ট্রের পরিচালকেরা। জড়িত শাসনযন্ত্রের মাননীয় ও মহামান্যরা। জড়িত জ্যেষ্ঠ আমলারা, অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা, কর প্রতারকেরা, ব্যাংকের ঋণখেলাপিরা। সমাজে আজ যাঁরা যত বিত্তবান, তাঁদের বিত্তের সঙ্গে তত বেশি অপরাধ জড়িয়ে আছে। দুর্নীতি, অন্যায়, অপরাধ অনৈতিকতারই অপর নাম। মাছের পচন যেমন শুরু হয় তার মাথায়, দুর্নীতির সংক্রমণও শুরু হয় অতি উঁচু মহল থেকে। পানি যেমন ওপর থেকে নিচে গড়ায়, দুর্নীতিও তেমনি সর্বদা অধোগামী। দুর্নীতির দ্বারা অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার ধন-সম্পদধারী আঙুল ফুলে কলাগাছেরা সম্পদের নিরাপত্তার জন্য তা দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। সম্পদ স্থানান্তরের বিশাল সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে বিশ্ব পুঁজি পাচারের একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠী। নানা কৌশলে অবৈধ পথে সম্পদ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। সম্পদ পাচার হচ্ছে। ডলার উড়ে যাচ্ছে। ধনাঢ্য বাংলাদেশিরা সম্পদ নিয়ে যাচ্ছেন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও মৌরিশাসে। বিনিময়ে এসব দেশে স্থায়ী বসবাস ও নাগরিকত্বের সুবিধা থাকছে।
দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিএনপির শাসনামলে, ২০০৪ সালে, অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের ঐকান্তিক চেষ্টায় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর চাপে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে দুর্নীতি দমন ব্যুরো ভেঙে প্রতিষ্ঠানটিকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার জন্য এ উদ্যোগ। কিন্তু দুদক তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই অকার্যকর থেকেছে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। রাজনীতির প্রভাব বলয়ের বাইরে সে অবস্থান নিতে পারেনি। কার্যত এটি নিষ্ক্রিয় থেকে সরকারের মুখাপেক্ষী হয়েছে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য যে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য রকমের অভিযান পরিচালনা করতে পেরেছিল। সাঁড়াশি অভিযান শক্ত আঘাত হানতে পেরেছিল ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে মহাপরাক্রান্ত বড় বড় দুর্নীতিবাজের দুর্গে। সারা দেশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। আর তা সম্ভব হয়েছিল দুদকের তদানীন্তন চেয়ারম্যান জেনারেল হাসান মশহুদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর প্রশ্নাতীত সততা ও নিষ্ঠার জন্য।
প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলের শক্ত অবস্থান প্রচারে। দুর্নীতি সমূলে উৎপাটনের অঙ্গীকার হয়ে ওঠে নির্বাচন-যুদ্ধ জয়ের অব্যর্থ অস্ত্র। কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখি, সরকার ও তার দল হয়ে ওঠে দুর্নীতিগ্রস্ত। ছাড়িয়ে যায় অতীতের সরকারগুলোকে। এ যেন রেকর্ড ভাঙার প্রতিযোগিতা। আজ রাষ্ট্রকাঠামোর মহান স্তম্ভ আইন, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ—প্রতিটি দুর্নীতিগ্রস্ত, ঘুণেধরা। আজ গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভূমি, কর মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সবাই দুর্নীতির পঙ্কিলে নিমজ্জিত। এ কথাগুলো আমার নয়; অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের। গত ১৯ মে রাজধানীর এক পাঁচতারা হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে বলেছিলেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের (মহাজোট) পাঁচ বছরের শাসনামল শেষ হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনী সরকার, যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন। গত সরকারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ও দারিদ্র্যবিমোচনে অর্জন থাকলেও দুর্নীতির রাহুগ্রাস তার সব অর্জন ম্লান করে দিয়েছে। দুর্নীতি এ সরকারের একিলির গোড়ালি। গ্রিক পুরাণের ট্রোজান যুদ্ধের মহান যোদ্ধা একিলির অভেদ্য দেহের সবচেয়ে দুর্বল অংশ ছিল তার গোড়ালি, যেখানে আঘাত দিলেই তার মৃত্যু।
২০০৫ সালে একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে কানাডা সফরের সুযোগ হয়েছিল কানাডার পার্লামেন্ট অধিবেশন দেখার। তখন লিবারেল পার্টির পল মার্টিন প্রধানমন্ত্রী। সংসদে সরকারের অর্থ কেলেঙ্কারি ও দুনীতির বিরুদ্ধে কনজারভেটিভ পার্টির দলনেতা স্টিফেন হারপারের জোরালো দীর্ঘ বক্তব্য আমি শুনেছিলাম। রাজধানী অটোয়ায় তখনই গুঞ্জন উঠেছিল, সরকার টিকবে না। আমার ঢাকা প্রত্যাবর্তনের আগেই মার্টিন সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তী নির্বাচনে স্টিফেন হারপার সরকার গঠন করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হন। এখনো তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী।
সরকার কখনো দুদককে স্বাধীন ও শক্তিশালী হতে দেয়নি। সব সময় চেয়েছে দুদককে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে। দুদক নামক ব্যাঘ্রটির শক্তি একের পর এক হরণ করে চলেছে। কখনো তার ধারালো দন্ত তুলে নিয়েছে, কখনো বা নখরগুলো ছেঁটে দিয়েছে। আর ১০ নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশন (সংশোধন) বিল ২০১৩ সংসদে পাস করে তার অবশিষ্ট ক্ষমতাটুকুও কেড়ে নিয়েছে। এখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা দিতে দুদককে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। দুদকের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন বলেছেন, ‘জাতীয় সংসদে আইন পাস করে দুদককে স্তব্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষ এ অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, রুখে দাঁড়াবে।’
হল-মার্ক কেলেঙ্কারি, ডেসটিনির প্রতারণা, পদ্মা সেতু দুর্নীতি, রেল কেলেঙ্কারি ইত্যাদির মতো স্পর্শকাতর অনেক বিষয়ে দুদক কাজ করছিল। দেশে-বিদেশে দুদকের কর্মকাণ্ড প্রশংসিত হচ্ছিল। এখন হঠাৎ করেই আইন করে দুদকের স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়েছে। আরও ভয়াবহ যে বিষয়টি, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত মিথ্যা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট দুদক কর্মকর্তারা তিন থেকে পাঁচ বছর কারাবাসের দণ্ডপ্রাপ্ত হবেন। এ যেন হাত-পা বাঁধা দুদককে সাগরে নিক্ষেপ করে সাঁতার কাটতে বলা।
আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ শ্রেণীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার এ আইন গোটা জাতিকে হতাশ করেছে। দুর্নীতিকে অপ্রতিরোধ্য ও উৎসাহিত করেছে। যে যত পারো লুটে যাও। লুটেপুটে খাও। আঙুল ফুলে বটগাছ হও। সম্পদ উপচে পড়ছে, বিদেশে পাচার করে দাও। পাঠিয়ে দাও সুইস ব্যাংকে, সিঙ্গাপুরের অ্যাকাউন্টে, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়। সম্পদ নিরাপদ। তুমিও নিরাপদ। বিদেশে স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে নাও। দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে বংশ পরিক্রমায় ভোগবাদী দুনিয়ায় ভোগ করে যাও।
লে. জে. মাহবুবুর রহমান (অব.): সাবেক সেনাপ্রধান।