দূরে থেকেও কাছে থাকা

করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি ফিরেছে মানুষ। অনেকের মতো মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরছিল কিশোর রিফাতও। গত বুধবার মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে ফেরি থেকে নামার সময় পদদলিত হয়ে মারা গেছেন মা নিপা আক্তার। জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় ঈদ কাটবে রিফাতের।
ছবি: প্রথম আলো

ঈদে ঢাকা ছেড়ে যেতে আমার কোনো দিন ভালো লাগে না। ছেলের স্কুলের ছুটির সঙ্গে অফিসের ছুটি মিলিয়ে বেড়াতে গেছি বছর বছর, কিন্তু পরিবারের কাছে আমার শর্ত ছিল একটাই, ঈদের দিন ঢাকায় থাকা চাই। এটা কি শুধু নিজের শহরের প্রতি টান? এ শহরে জন্মেছি, বেড়ে উঠেছি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র, সংসার… সব এ শহরে । স্মৃতিতে ঢাকা, ঢাকা শহর।

তবে আমার কাছে ২৮ বছর ধরে ঈদের দিনের বিশেষ কিছু পাওয়া মানে দুপুরে মা-বাবার বাড়িতে যাওয়া, তাঁদের সালাম করা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করা, অলস অবসরে বসে পরিবারের অনেকে মিলে জমানো গল্পগুজব করা। পুরোনো মজার স্মৃতি মনে করে হাহা হিহি করা। বাবার হাত থেকে এই মধ্যবয়সেও সেলামি পাওয়া। প্রতিবার টাকা ধরে বাবার সেই হাত ধোয়া নিয়ে আমাদের হাসিতামাশা করা। (তখন কি আর জানতাম এই হাত ধোয়াই আমাদের জীবন রক্ষা করবে?) এর মধ্যেই কেউ বালিশ টেনে ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ ঘুম কাটাতে সবার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসে। আর এই ঈদের দুপুরটা আমি কখনোই হারাতে চাই না বলে ঢাকাও ছাড়তে চাই না। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া কত আয়োজন, কত দাওয়াত কোনো কিছুই মা-বাবার সঙ্গে এই ঈদের দুপুর কাটানোর চেয়ে বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে আমাকে আকর্ষণ করতে পারেনি। তাই মানুষ কেন ঈদে বাড়ি ছুটে যায়, তা বোধ করি বুঝতে পারি।

এক পাড়ায় প্রায় ২০ বছর শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে যখন আমরা নিজেদের বাড়িতে যাচ্ছিলাম, তখন কান্না চাপতে পারিনি। মনে হচ্ছিল নতুন জায়গায় গিয়ে কী করে থাকব? আশ্চর্যের বিষয়, কিছুদিন পর পুরোনো পাড়াতে গিয়ে বুকের গভীরের ওই কান্না আর অনুভব করিনি, তবে ফেলা আসা স্মৃতিগুলো ভিড় করছিল মনে। আজও করে। যেদিন আমাদের সেই পুরোনো বিল্ডিং ভেঙে ফেলা হচ্ছিল, হাজার ঝামেলা সত্ত্বেও গিয়ে ছবি তুলে এনেছিলাম। স্মৃতিতাড়িত হয়ে। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এমন কেন হলো? বাবা বলেছিলেন, ‘তুমি তো তোমার পরিবারের প্রিয় মানুষগুলোকে সঙ্গে করে নতুন বাড়িতে এসেছ। তাই তো, আমরা যে পরিবারের মানুষগুলোকে ঘিরেই থাকতে ভালোবাসি। পরিবার তো ইট-বালু-সিমেন্ট নয়।’

আর এবার নিয়ে তিনটি ঈদ এই ঢাকা শহরে থেকেও মা-বাবার কাছে যেতে পারছি না। তাঁদের বয়স ৮০, ৮১ বছর। দূর থেকে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। শুধু চাই তাঁরা সুস্থ থাকুন, বনস্পতির ছায়া মেলে ধরুন দীর্ঘকাল। না-ই হলো পায়ে হাত দিয়ে সালাম, না-ই হলো মাথায় আশীর্বাদের স্পর্শ। দূরে থেকেও তো কাছে থাকা যায়। বিধিনিষেধ মেনে যদি তাঁদের ঝুঁকিমুক্ত রাখা যায়, তবে তা-ই হোক।

ঝুঁকিমুক্ত কথাটা আমরা বলি বটে, মানি কজন? মানুষের জীবন রক্ষার চাইতে আর কিই-বা বড় হতে পারে? বেঁচে থাকলে তবে তো পরিবারের সঙ্গে থাকা হবে। ঈদের সময় বাড়ি ফেরা মানুষের চাপে লঞ্চ ডুবে যায়, জাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পদদলিত হয় গরিব মানুষ। এ ধরনের খবর ছাপতে ছাপতে এবং পড়তে পড়তে আমাদের ইন্দ্রিয় ভোঁতা হয়ে গেছে। আর এবার করোনাকালে বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে বাড়ি ছুটে চলা মানুষের দুর্ভোগ তো দেখাই গেল। যার যায় সে-ই জানে কী যায়? ফেরি থেকে নামার সময় ভিড়ের চাপ সহ্য করে যাঁরা বাড়ি পৌঁছেছেন, তাঁরা তো বেঁচেই গেলেন। আর যে পাঁচজন পদদলিত হয়ে মারা গেলেন, তাঁদের পরিবার জানে কোন ঈদ তারা কাটাবে?

* সুমনা শারমীন: ফিচার সম্পাদক, প্রথম আলো