দেশ কি সহিংসতার দিকে এগোচ্ছে?

বাংলাদেশের মানুষ দিন দিন নানা মাত্রার শঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে উঠছে। হাইকোর্ট কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনকে অবৈধ ঘোষণার পর ১৩-১৪ আগস্ট দলটি দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে। মানুষের ভোগান্তি তৈরি করে যে রাজনীতি, তার প্রয়োজনটা কী? এদিকে বিএনপির নেতারা হুমকি দিয়ে রেখেছেন যে ঈদের পর ‘বাংলা বসন্ত’-এর মাধ্যমে সরকারকে বিদায় করে দেওয়া হবে। এ পরিস্থিতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেকে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখা এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে বৃহৎ দুটি রাজনৈতিক দলের যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা দরকার ছিল, সে ভূমিকা তারা পালন করতে পারছে না। ফলে জামায়াতে ইসলামী সহিংসতা করার সুযোগ পাচ্ছে। উত্থান ঘটছে হেফাজতে ইসলামের মতো প্রগতিবিরোধী পশ্চাৎপদ শক্তির। বাংলাদেশের রাজনীতি যদি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির হাতে থাকে, তাহলে তা অধিকতর স্থিতিশীল, নিয়ন্ত্রিত ও সহনীয় হয় বলে অধিকাংশ মানুষ মনে করে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশবিরোধী ভূমিকা ও সহিংসতা এবং হেফাজতে ইসলামের নারীবিদ্বেষ ও পশ্চাৎপদতা বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য বিধ্বংসী পরিণতি বয়ে নিয়ে আসবে বলে আমাদের আশঙ্কা। বৃহৎ দল হিসেবে এ ব্যাপারে বিএনপিকে অনেক বেশি সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে।

দুই.
সুশীল সমাজ, সচেতন নাগরিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে দাবি জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির উচিত জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের বিষয়টিকে পুনর্মূল্যায়ন করা। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি রায়ে জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী সংগঠন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী ‘হন্তারক বাহিনী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ বিষয়টিকে আমলে নিয়ে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, নাকি সুশীল সমাজের মতামত, সচেতন নাগরিকদের উৎকণ্ঠা সবকিছুকে উপেক্ষা করে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ২০০১ সালে বিএনপি এককভাবেই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জাতীয় সংসদে ১৯৩টি আসন পেয়েছিল। ওই নির্বাচনে বিএনপি দল হিসেবে পেয়েছিল মোট ভোটের ৪১.৪০ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.০২ শতাংশ। মাত্র ৪.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা পেয়েছিলেন ১৭টি আসন। তাহলে ভোটের রাজনীতির পরিসংখ্যানও বলছে যে বিএনপির প্রার্থীরা জামায়াতের সমর্থন ছাড়াও জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের সামর্থ্য রাখেন। তাহলে বিএনপি কেন জামায়াতে ইসলামীর মতো ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘হন্তারক’ দলের দায় নিচ্ছে?

তিন.
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যদি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে, তাহলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও ইতিমধ্যে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নিয়ে বিএনপিকে বিপাকে পড়তে হবে। কেননা, এ বিষয়ে তাদের অবস্থা পরিষ্কার নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে বিএনপির বক্তব্য হচ্ছে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে বর্তমান সরকার এ বিচার করছে। তারা এ বিচারটিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছে। বিএনপির কোনো কোনো আইনজীবী নেতা বিচার-প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন, এমনকি একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করার দাবিও জানিয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিলুপ্ত করে দেবে, না পুনর্গঠন করবে? যাঁদের ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ড বা বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, জামায়াতে ইসলামের চাপে তাঁদের দণ্ড মওকুফ করে বিএনপি তাঁদের মুক্তির ব্যবস্থা করবে? তাহলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম বছর থেকেই বিএনপিকে তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হবে, যেমনটি হয়েছিল ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পর শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। এবারের আন্দোলন হবে আরও বেশি তীব্র, ব্যাপক-বিস্তৃত ও গণসম্পৃক্ত। কেননা, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, সচেতন জনগোষ্ঠী এবং গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের ব্যাপারে কোনো ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। ফলে, এ ব্যাপারে বিএনপির জামায়াতবান্ধব নীতি তাদের জন্য আত্মঘাতী হবে।

চার.
হেফাজতে ইসলামের গণজমায়েতকে খাটো না করেও যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, ওটি ছিল সারা দেশের মাদ্রাসাছাত্র ও শিক্ষকদের অভূতপূর্ব সমাবেশ। শাহবাগে যেমন সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল, হেফাজতের সমাবেশে তা হয়নি। শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে খুঁজে পেয়েছি সাম্প্রদায়িক ও পশ্চাৎপদ এক বাংলাদেশকে। তরুণ প্রজন্ম, নারী এবং সচেতন জনগোষ্ঠী শাহবাগকে নিয়েছে এবং শাহবাগের চেতনায়ই উজ্জীবিত হবে। নানা অপপ্রচার করে হেফাজতের মাধ্যমে সাময়িকভাবে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে, কিন্তু পরিণামে বাংলাদেশের জন্য তা ভালো ফল বয়ে আনবে না। শাপলা চত্বরে জড়ো হওয়া হাজার হাজার হেফাজত কর্মী জানেনই না, এসবের সঙ্গে শাহবাগ আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। বিএনপি ক্ষমতায় এসে যদি হেফাজতে ইসলামের চাপে নারীদের শিক্ষা ও কাজ করার অধিকার সংকুচিত করে বা বন্ধ করে দেয়, তাহলে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে একটি নারী জাগরণ দেখার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। আর বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর কূটচাল এবং হেফাজত-তোষণ নীতি যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে জঙ্গিবাদ উত্থানের ঝুঁকি যেমন থাকবে, তেমনি ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে বিভক্ত, সহিংস ও সন্ত্রাসকবলিত।
 শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]