‘দ্রুত তাঁদের ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করো’

পাকিস্তানের ম্যাংগ্রো সাবমেরিনে প্রশিক্ষণরত আট বাঙালি নৌসেনার দুঃসাহসের গল্প। মার্চ মাসের ২৯ তারিখ। তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়নি। কিন্তু ফ্রান্সের নৌঘাঁটিতে থাকা ওই বাঙালি নৌসেনারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে ভারত হয়ে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাঁদের অভিযাত্রা নিয়ে দুই পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব

অপারেশন এক্স বইয়ের প্রচ্ছদ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা চালায়, তখন ফ্রান্সের উপকূলে সাবমেরিন ম্যাংগ্রোতে অন্যদের সঙ্গে ১৩ বাঙালি নৌসেনা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গণহত্যার খবর প্রকাশ পেলে তাঁরাও জানতে পারেন দেশে কী ঘটছে। তুলোঁ নৌঘাঁটিতে চূড়ান্ত মহড়ার জন্য সাবমেরিনটি অপেক্ষা করছিল। মহড়া শেষে ১ এপ্রিল করাচির উদ্দেশে যাত্রা করার কথা।

এরই মধ্যে বাঙালি নৌসেনা আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী মনস্থির করলেন, এর আগেই পালাতে হবে। যে সেনাবাহিনী নিজের দেশের মানুষকে হত্যা করে, সেই বাহিনীর সেবা তাঁরা করতে পারেন না। এর আগে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণেও তিনি ও তাঁর সতীর্থরা মুক্তিযুদ্ধের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। তাঁরা জানতেন, সাবমেরিন থেকে পালিয়ে যাওয়া দেশদ্রোহ। ধরা পড়লে কঠিন শাস্তি। এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।

ওয়াহিদ অন্যান্য বাঙালি নৌসেনার সঙ্গে কথা বললেন। তাঁদের মধ্যে নয়জন সিদ্ধান্ত নেন, সাবমেরিন বন্দর ছাড়ার আগে পালিয়ে যাবেন। অপর চারজনের পরিবার পাকিস্তানে থাকায় তাঁরা পালাতে সাহস পেলেন না। তবে কথা দিলেন, বিষয়টি গোপন রাখবেন। কিন্তু কোথায়, কীভাবে যাবেন, কিছুই জানতেন না নৌসেনারা। তাঁরা ভাবলেন, বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি ভারত সহানুভূতিশীল। তাদের সহায়তা চাওয়া যেতে পারে।

আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী ছিলেন সাবমেরিন কমান্ডিং অফিসারের সেক্রেটারি। ৪৫ জন প্রশিক্ষণার্থীর পাসপোর্ট তাঁর জিম্মায়। তিনি নয় বাঙালি নৌসেনার পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। তাঁরা হলেন গাজী রহমতউল্লাহ, শেখ আমানুল্লাহ, সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, আবদুল রকিব মিয়া, বদিউল আলম, আহসানউল্লাহ, আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী, আবদুল মান্নান ও আবিদুর রহমান।

এরপর ওয়াহিদ সবাইকে রাত সাড়ে ১২টায় মারসেই রেলস্টেশনে দেখা করতে বলেন। ২৯ মার্চ সূর্যাস্তের পর নয় নৌসেনা তুলোঁ নৌঘাঁটি ত্যাগ করেন ৪৮ কিলোমিটার দূরের রেলস্টেশনের উদ্দেশে। তাঁরা আলাদাভাবে ঘাঁটি ছাড়েন, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে। তাঁদের জিনিসপত্র সরাতে দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকজন সেনা সহায়তা করেছিলেন।

আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরীর কাছে নয় নৌসেনার পাসপোর্ট। তাঁদের মধ্যে আবদুল মান্নান লন্ডন যাবেন তাঁর আত্মীয়র কাছে। ওয়াহিদ ঠিক করলেন, জেনেভা যাবেন। তাঁদের কাছে নৌবাহিনীর যে পোশাক ছিল, তা–ও ফেলে দিলেন। কিন্তু ভিসা না থাকায় তাঁরা সুইজারল্যান্ড ঢুকতে পারেননি। ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা যাতে সন্দেহ না করেন, সে জন্য দ্রুত পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে বললেন, তাঁরা প্যারিসে গিয়ে ভিসা নিয়ে আসবেন। এরপর নৌসেনারা প্যারিসগামী ট্রেনে উঠলেও সেখানে গেলেন না। ১০০ কিলোমিটার দূরে লিও শহরে নেমে পড়েন। সেখান থেকে বার্সেলোনা।

ওয়াহিদ চৌধুরী খোঁজ নিয়ে জানলেন, পাকিস্তানি নাগরিকেরা ভিসা ছাড়া স্পেনে যেতে পারেন। বার্সেলোনা গিয়ে সেখানকার ভারতীয় কনস্যুলেট অফিসে যোগাযোগ করেন। তারা মাদ্রিদে তাদের দূতাবাসে যেতে বলে। আবার শুরু হলো তাঁদের যাত্রা।

মাদ্রিদের ভেলাকুইজে ভারতীয় দূতাবাস। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বুধবার, ৩১ মার্চ। দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব গুরদীপ বেদি অফিস ত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কালো শ্মশ্রুধারী ৩০ বছর বয়সী ভারতীয় পররাষ্ট্র সার্ভিসের এই কর্মকর্তার আদি বাড়ি পাকিস্তানের সারগোদায়। রাষ্ট্রদূত ছুটিতে থাকায় তাঁকে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে অফিসের দরজায় দুজন নক করলেন। আবদুল ওয়াহিদ চৌধুরী ও গাজী মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ। বেদি দরজা খুলতেই বিচলিত দুই বাঙালি নৌসেনা তুলোঁ নৌঘাঁটি থেকে তাঁদের পালিয়ে আসা এবং গত দুই দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তাঁরা ভারতে আশ্রয় চাইলেন, যাতে বাংলাদেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারেন।

গুরদীপ বেদি তাঁদের পাসপোর্ট পরীক্ষা করে পরিস্থিতি আঁচ করলেন। তিনি জানতেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাঁর নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে। তবে তিনি আতিথেয়তায় কার্পণ্য করলেন না। জিজ্ঞাসা করলেন, অন্য নৌসেনারা কোথায়?

ওয়াহিদ চৌধুরী বললেন, তাঁরা শহরেই আছেন, কোথাও ঘোরাফেরা করছেন। বেদি জিজ্ঞাসা করলেন, তাঁদের কাছে যথেষ্ট টাকাপয়সা আছে কি না। তাঁরা বললেন, খাবারের টাকা আছে। হোটেলে থাকার মতো টাকা নেই। বেদি তাঁর অধস্তনকে কাছাকাছি সস্তা দামের একটি স্প্যানিশ হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। এরপর তিনি দিল্লিতে জরুরি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে তাঁর করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলেন। পরদিন সকালেই বার্তা এল, ‘দ্রুত তাঁদের ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা করো।’ তিনি ভাবেননি এত কম সময়ে উত্তর পাবেন।

এরপর বেদি ভাবলেন, এ ব্যাপারে স্পেনের সহায়তা চেয়ে লাভ হবে না। ১৯৫৬ সালে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও আবাসিক দূতাবাস হয়েছে ১৯৬৫ সালে, মাত্র পাঁচ বছর আগে। দুই দেশের সম্পর্ক শীতল। তিনি নিজেই বাঙালি নৌসেনাদের দেশে পাঠানোর দায়িত্ব নিলেন। প্রথম টেলিফোন করলেন মাদ্রিদে ভারতীয় বিমানের লিয়াজোঁ অফিসের পাবলো ওল মেদাকে। তাঁকে বললেন, পরদিন সকালে রোমগামী বিমানের জন্য আটটি টিকিট বুক করে রাখতে।

এরপর বেদি আট নৌসেনার জন্য অস্থায়ী ট্রাভেল ডকুমেন্ট ইস্যু করলেন। তাঁদের পাসপোর্ট থেকে ছবি তুলে ট্রাভেল ডকুমেন্টে বসিয়ে দিলেন। ডকুমেন্টে নামগুলো বদলে দেওয়া হলো যথাক্রমে রাম কুমার, সিং, দত্ত...।

পরদিন সকালে আট বাঙালি নৌসেনা শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে মাদ্রিদ বিমানবন্দরে পৌঁছালেন। বেদি দ্বিতীয়বার তাঁদের সঙ্গে আর দেখা করলেন না। দূতাবাসের অন্য কর্মকর্তারা বিমানবন্দরের ভেতরে চলে গেলেন। অন্যদিকে, ওয়াহিদ ও তাঁর সঙ্গীরা ইমিগ্রেশনে পাকিস্তানি পাসপোর্টে সিল মেরে ভেতরে ঢুকলেন। ইমিগ্রেশন পার হয়ে তাঁরা ভারতীয় কূটনীতিকেরা যেখানে ছিলেন, সেখানে গিয়ে তাঁদের কাছ অস্থায়ী ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিলেন। কিছুক্ষণ আগেও তাঁরা ছিলেন পাকিস্তানি নাগরিক। ট্রাভেল ডকুমেন্ট অনুযায়ী এখন ভারতীয়।

সূত্র: অপারেশন এক্স: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব ইন্ডিয়াস কভার্ট নেভাল ওয়ার ইন ইস্ট পাকিস্তান ১৯৭১

  • আগামীকাল পরবর্তী কিস্তি: ২৬ মার্চ আমাদের নবজন্ম, যুদ্ধে যাচ্ছি...