ধর্ষকেরা কি সবাইকেই বেঁধে রেখেছে?

প্রথম সারিতে বাঁ থেকে সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম ও শাহ মাহবুবুর রহমান দ্বিতীয় সারিতে বাঁ থেকে অর্জুন লঙ্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান
ছবি: সংগৃহীত

স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে ধর্ষণ, মা ও মেয়েকে একসঙ্গে ধর্ষণ-সব দেখেছে এই মাটি। ধর্ষণের শিকার নারীর পিঠের তলার ওই জমিন-ওই জমিন হাজার বছরের সাক্ষী। নারীর শরীর ও মন এক জাদুঘর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নানা ধরনের যৌন নিপীড়নের স্মৃতি পোড়ামাটির দাগের মতো তারা বহন করে চলে। ধর্ষণের ভয় নিয়েই বড় হয়ে ওঠে আমাদের মেয়েশিশুরা।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা ধর্ষণ ও গণহত্যা চালিয়েছে। আমাদের দেশে উদ্বাস্তু হয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীরাও বয়ে এনেছে বর্মী সেনাদের দ্বারা ধর্ষণের বুকচাপা গল্প। নির্যাতিতা নারীদের পিঠের নিচের মাটিতে দাগ বসে গেছে, কিন্তু ধর্ষণের শিকার হওয়ার এই ইতিহাস এই জনগোষ্ঠী ভুলে গেছে। নির্যাতিত হতে হতে নির্যাতিতরা একসময় তাদের সাবেক প্রভুদের অনুকরণ করা শুরু করে। বাঙালি পুরুষ তার মা মাটি ও ভাইবোনদের বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, খুবই স্বাভাবিক ছিল যে, স্বাধীন দেশে তারা কিছুতেই ধর্ষণ, দাঙ্গা, বিচারবহির্ভূত হত্যা সহ্য করবে না। কিন্তু সেটা হয়নি। মারাঠা বর্গীরা নেই, পাকিস্তানি জান্তা নেই, জমিদারের লেঠেলেরা নেই, কিন্তু ধর্ষণ আর হত্যা এই মাটিতে আজও রাজত্ব করছে।

কেন আমরা শিখলাম না? নিলাম না কোনো শিক্ষা?

এটাই আমাদের জাতীয় অতীত-গৌরবের সোনালি মুদ্রার উল্টা পিঠ। আমরা না দেখলেও, চাঁদের সেই উল্টা পিঠ আমাদের দেখে। কিন্তু তার গায়ে সূর্যের আলো না পড়ায় আমরা বলি, কই কিছুই তো দেখা যায় না, শুধু অন্ধকার’। আমরা না দেখলেও নারী নির্যাতনের ইতিহাস হাজার বছর ধরেই চলমান। ‘এখনো গেল না আঁধার’ রবীন্দ্রসংগীত কেউ গাইছে। কেউ গাইছে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

সেই বাংলার মাটিতে মারাঠা বর্গিরা লুট আর হত্যার সঙ্গে ধর্ষণ করেছে নারীদের। মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরাও করেছে। দাঙ্গার মধ্যে এই কাজ করেছে অন্য সময়ে নিরীহ হয়ে থাকা পুরুষেরা। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারা অবাধে ধর্ষণ ও গণহত্যা চালিয়েছে-এই মাটিতেই। সেই একই মাটি দেখছে সেই একই ইতিহাস।

কিন্তু পরিচয় বদলে গেছে ধর্ষকের। বহিরাগত দস্যু বা দখলদারেরা ভেবেছে, এরা পরনারী, এরা পরদেশী, এই মাটি দখলাধীন-এখানে যা ইচ্ছা তা-ই করা যায়। যুদ্ধে মানুষ দানব হয়ে যায়, দলবদ্ধ ধর্ষণ সেসব যুদ্ধবাজ দানবের কাজ। আরাকান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা নারী বয়ে এনেছে বর্মি সেনাদের দ্বারা ধর্ষণের বুকচাপা আর্তনাদ। কিন্তু নিজ দেশের নিজ রাষ্ট্রের নারীদেরও দখলদারের কায়দায় দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ করাই আমাদের ‘নতুন স্বাভাবিকতা’!

পার্বত্য চট্টগ্রামে নয় বাঙালি মিলে এক পাহাড়ি নারীকে ধর্ষণ করেছে মা-বাবার সামনে। সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের ছয় বীরপুঙ্গব স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে। যুদ্ধে নাকি এসব হয়। তাহলে এখানে কার সঙ্গে কার যুদ্ধ চলছে?

যে দেশের ইতিহাসে, যে দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে লাখো নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার আত্মত্যাগ, সেই দেশে ধর্ষণবিরোধী চেতনাই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হওয়ার কথা। নির্যাতিতা নারীদের পিঠের নিচের মাটিতে দাগ বসে গেছে, অথচ অনেকের মনে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠিন নিষেধের দাগ নেই।

নির্যাতিত হতে হতে নির্যাতিতেরা একসময় তাদের সাবেক প্রভুদের অনুকরণ করা শুরু করে। বাঙালি পুরুষ তার মা, মাটি ও দেশ বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। কথা ছিল সেই দেশের মানুষ কিছুতেই ধর্ষণ, দাঙ্গা, বিচারবহির্ভূত হত্যা সহ্য করবে না। কিন্তু সেটা হয়নি। মারাঠা বর্গিরা নেই, পাকিস্তানি জান্তা নেই, জমিদারের লেঠেলেরা নেই, কিন্তু ধর্ষণ আর হত্যা এই মাটিতে আজও রাজত্ব করছে। জীবন ও ধর্ষণ এখানে একসঙ্গেই চলছে।

ইতালীয় চলচ্চিত্র পরিচালক ভিক্তরিও ডি সিকা তাঁর দেশের লাঞ্ছনার প্রতীক করেছিলেন আশ্রয় খুঁজতে থাকা মা ও মেয়ের ধর্ষণের ঘটনাকে। সেই বিখ্যাত ছবিটির নাম ‘টু উইমেন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটুভূমিতে এ রকম একটি ঘটনায় আলোড়িত হয়ে সিনেমা বানিয়েছিলেন ডি সিকা। আমাদের এখানে কোনো যুদ্ধ চলছে না। কিন্তু মা ও মেয়ে একত্রে ধর্ষিত হচ্ছেন। বাবা-ভাই বা স্বামী হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তা সহ্য করছেন।

বলপ্রয়োগের এই সংস্কৃতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতির মজ্জারস। শরীরের গিঁটে বেশি রস জমলে বাতের ব্যথা বাড়ে। তেমনি ক্ষমতার বদরস রাষ্ট্র ও সমাজের গিঁটে গিঁটে বেশি জমে গেলে তা টাটায়। কারও ওপর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সেই বিষ কমায় ক্ষমতাবান পুরুষের দল। ধর্ষণ তাই বলপ্রয়োগের রাজনীতির যৌন সন্ত্রাসের দিক-অন্যান্য সন্ত্রাসের ভায়রা ভাই। পুরুষের দৈহিক ‘ক্ষমতা’ রাজনৈতিক। রাষ্ট্রের, টাকার ও দাপটের ক্ষমতার সঙ্গে জোট বেঁধেই সেই ক্ষমতা ধর্ষকের ক্ষমতা হয়ে ওঠে। এত সব ক্ষমতাকেন্দ্রের ছায়াতেই কিছু কিছু পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, যুদ্ধে, প্রেমে, সংসারে ও সমাজে। এসব ক্ষমতাকে প্রশ্ন না করে, ধর্ষণের সম্পূর্ণ বিচার করা সম্ভব নয়।

বলপ্রয়োগের ক্ষমতায় অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুঁড়িয়ে দেওয়াই প্রথম অনাচার। এই অনাচারের কোলেই বড় হয় ধর্ষকের চারা। ধর্ষকের বিরুদ্ধে ঘৃণা পুষে রেখে, ধর্ষকের বিচার করে সেই বলপ্রয়োগের ক্ষমতাকে বশ করা যায় না। বলপ্রয়োগ হলো ধর্ষণপাহাড়ের চূড়া। চূড়াটা টিকিয়ে রেখে পাহাড়ের একটি-দুটি পাথর ভাঙলেও পাহাড় পাহাড়ই থাকে।

পুরুষের দৈহিক ‘ক্ষমতা’ রাজনৈতিক। সেই ক্ষমতা রাষ্ট্রের, টাকার ও দাপটের ক্ষমতার সঙ্গে জোট বেঁধেই ধর্ষণের ক্ষমতা হয়ে ওঠে। এসব ক্ষমতাকে প্রশ্ন না করে, ধর্ষণের সম্পূর্ণ বিচার সম্ভব নয়। এত সব ক্ষমতাকেন্দ্রের ছায়াতেই কিছু কিছু পুরুষ ধর্ষক হয়ে ওঠে, যুদ্ধে, প্রেমে, সংসারে ও সমাজে। ধর্ষকের জয়ের তালি এক হাতে বাজে না। আরেক হাত ক্ষমতার। ক্ষমতাদণ্ডই ধর্ষকের আসল দণ্ড। পারলে সেই দণ্ডকে দণ্ড দিন।

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক।

[email protected]