নতুন বাস্তবতায় বাংলাদেশ–কাতার সম্পর্ক

নির্মাণশিল্প খাতের জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল কাতার।


বাংলাদেশ ও কাতারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভিত্তিমূলে অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা সম্পর্কিত অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধের প্রেক্ষাপটে এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং অত্যাবশ্যক।
দুই দেশের মধ্যে মনোভাবের মিলের এই জায়গা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থপূর্ণ সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরও দৃঢ় এবং প্রসারিত করবে বলে আশা করা যায়। সেই সঙ্গে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম। দুই দেশের সুসম্পর্ক এবং বাংলাদেশের বলিষ্ঠ পররাষ্ট্র নীতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যাশিতভাবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কাতার বাংলাদেশের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলা যায় যে এই সম্পর্কের তিনটি প্রধান স্তম্ভ রয়েছে।
প্রথম স্তম্ভটি হচ্ছে, কাতারের অবকাঠামো উন্নয়নসহ নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত চার লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির উপস্থিতি। এই বিপুল জনগোষ্ঠী আমাদের রেমিট্যান্সের অন্যতম উৎস। এমনকি এই করোনাকালেও কাতার থেকে আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ থেমে থাকেনি। এটি আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতিরও অংশ। তা ছাড়া প্রবাসী ভাইবোনেরা বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে একটা সেতুবন্ধের কাজও করছেন। করোনাকালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মহামারির গ্রাস থেকে রক্ষার জন্য কাতার সরকারের আন্তরিকতা এবং এই দেশে কর্মরত বাংলাদেশি চিকিৎসকদের সময়োপযোগী ভূমিকা এই বন্ধনকে আরও মজবুত করেছে।
দ্বিতীয় স্তম্ভ হচ্ছে, দুদেশের মধ্যেকার বাণিজ্য সম্পর্ক, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে কাতার থেকে জলবায়ুবান্ধব এলএনজি আমদানি একটা বড় ভূমিকা রাখছে। এর ফলে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এক বিলিয়ন ডলারের সীমা অতিক্রম করে গেছে। আমাদের রপ্তানি ঝুড়িতে আরও পণ্যসামগ্রী যোগ করার মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে বাণিজ্যের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব। তার জন্য দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে কার্যকর সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্মোচন করা প্রয়োজন।

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের তৃতীয় স্তম্ভটিকে একটা ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, যেখানে সহযোগিতার অনেকগুলো ক্ষেত্র রয়েছে। তার মধ্যে প্রধানতম হলো কাতার থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ। এ ছাড়া রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ দুই দেশের জনগণ পর্যায়ে নানা বিষয় নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা।
কাতারের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের দুটো প্রধান বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এর একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। এ ক্ষেত্রে আমাদের দৃশ্যমান অর্জন রয়েছে। তবে এতে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক কূটনীতির বাণিজ্যিক এবং জনশক্তির দিকের অর্জনকে সংহত করে কাতারে আমাদের বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ আছে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে অদক্ষ, আধা দক্ষ কর্মী শ্রেণির পাশাপাশি দক্ষ পেশাজীবী শ্রেণি আরও বেশি পরিমাণে কাতারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ নিতে পারেন। দক্ষ পেশাজীবী শ্রেণি সাধারণভাবে পরিচিত কর্মসংস্থানের দেশগুলো অর্থাৎ উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের পাশাপাশি কাতারেও সন্তোষজনক কাজ খুঁজে পেতে সক্ষম হতে পারেন। কাতারে দক্ষ পেশাজীবী শ্রেণির সংখ্যা বাড়লে সেটা বাংলাদেশের জন্য কয়েক দিক দিয়ে লাভজনক হতে পারে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, কাতারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের তৃতীয় স্তম্ভ, যা একটা ঝুড়ির সঙ্গে তুলনীয়, সেই ঝুড়িতে বিনিয়োগসহ যেসব বিষয় আছে, তার প্রতিটি বিষয়কে একেকটি আলাদা স্তম্ভে রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া। যেমন বিনিয়োগ সম্পর্ক আরও সুসংহত হলে, অর্থাৎ বিনিয়োগের পরিমাণ সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পেলে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ সম্পর্ক নিজেই একটি আলাদা স্তম্ভে পরিণত হবে। একইভাবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাত (যা কাতার সরকারের দুটি প্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়) আলাদা আলাদা স্তম্ভ হিসেবে নিজেদের স্থান করে নিতে সক্ষম হতে পারে। এভাবে স্তম্ভ বৃদ্ধির অর্থাৎ সহযোগিতার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করার কয়েকটি ইতিবাচক দিক রয়েছে।
এ ধরনের সহযোগিতার প্রতিটি ক্ষেত্রে দুই দেশ পারস্পরিকভাবে লাভজনক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে টেকসই হয়ে উঠবে। অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এ ধরনের অগ্রগতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দুই দেশের সহযোগিতাকে আরও বেগবান করবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ-কাতার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এ ধরনের উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না। এককথায় এর উত্তর হচ্ছে, সম্ভব। তার কয়েকটি কারণ রয়েছে।
এক. দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে কোনো বিরোধপূর্ণ বিষয় নেই, যা সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হতে পারে। বস্তুত, দুই দেশের বর্তমান সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ। কাজেই সম্পর্কে আরও মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্র প্রস্তুত আছে।

দুই.

অর্থনৈতিক কূটনীতি এগিয়ে যাওয়ার জন্য সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান এবং সেই সঙ্গে এর জন্য পরিবেশ অনুকূল আছে। যেমন বাংলাদেশ থেকে পেশাদার শ্রেণিকে কাতারে স্বাগত জানানোর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কাতারের সংশ্লিষ্ট মহলে বিরাজমান। অথবা বিনিয়োগের জন্য কাতার যেকোনো অনুকূল পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে প্রস্তুত, যে ধরনের অনুকূল পরিবেশ বাংলাদেশে বিরাজমান রয়েছে।
তিন.দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত আলাপ–আলোচনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ হয়। সম্পর্কের নানা ক্ষেত্র সম্পর্কে একটু আগে যা বলা হলো, সেই ক্ষেত্রগুলোকে দৃঢ় করার জন্য এই প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম। সেই সঙ্গে এ ধরনের বৈঠকে সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত করারও সুযোগ রয়েছে।
এই পর্যায়ে প্রশ্ন হলো, এই মুহূর্তে দুই দেশের করণীয় কী। আমার মতে, আমাদের তিনটি কাজ করতে হবে। এক. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠক নিয়মিত আয়োজন করা। দুই.ব্যবসায়ীদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা, যা পরবর্তী সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগের দিকে যেতে পারে। তিন.রাজনৈতিক পর্যায়ে সফর বিনিময়।


মো. জসীম উদ্দিন কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত