নামকরণের সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতি

চরম শত্রু মহাশক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পেটের ভেতরে অবস্থান নিয়ে ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর দেশকে প্রায় ৫০ বছর নেতৃত্ব দিয়ে মৃত্যুর পূর্বে বলে গিয়েছেন তাঁর নামে যেন কোনো স্থাপনা কিংবা প্রতিষ্ঠান না হয়। বিভিন্ন দেশে ফিদেল কাস্ত্রোর নামাংশ দিয়ে স্থাপনা কিংবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু নিজ দেশে নেই। বিশ্ববিখ্যাত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ডিরাক তাঁর নামে যে ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান রয়েছে, তা পড়ানোর সময় শুধুই ফার্মির নাম উচ্চারণ করতেন। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিরুদ্ধে যে সুনামি হয়েছিল তাতে শুধু ইউক্রেনেই লেনিনের ১ হাজার ৩২০টি মূর্তি উপড়ে ফেলা হয়েছে। ইথিওপিয়া, জার্মানি, ভারত, মলদোভাসহ অন্যান্য দেশে শ সাতেক লেনিনের মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনাগুলো কী দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ফিদেল কাস্ত্রোকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল?

পৃথিবীর কোটি কোটি ছাত্র-শিক্ষক কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিক অ্যাঙ্গেলস ও লেনিনের তত্ত্ব পড়ে পাস করেছেন, জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়েছেন, বই পুস্তক লিখে সমাজের গতিপ্রকৃতি ব্যাখ্যা করে বাহবা পেয়েছেন, পুরস্কার স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনা আবরণকেন্দ্রিক ভাসা ভাসা অগভীর। মিছিলে গেলে আমরা জানি না মিছিলের কারণ কী। একুশে ফেব্রুয়ারি, সাতই মার্চ, ছয় দফা, গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ  সম্পর্কে সাম্যক উপলব্ধি আমাদের আছে কি না সন্দেহ।

বড় বড় সভা সমিতি যাঁদের অংশগ্রহণে জনসমুদ্র হয়, পট পরিবর্তনে ঠিক বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গির সভা সমিতিকে তাঁরাই জনসমুদ্রে রূপান্তর করেন। একটি চিন্তাচেতনা দর্শনের সম্যক উপলব্ধি না থেকেও যাঁরা তাকে সমর্থন করেন, তাঁরা কোনো পক্ষেরই প্রকৃত শক্তি হতে পারেন না। এ জন্যই কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তার হঠকারিতার বলি হলো গোটা সমাজ, মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল দর্শন, চিন্তাভাবনা সবকিছু। পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠান, স্থাপনার নামও পরিবর্তন হয়ে গেল, মুখের বুলির পরিবর্তন হলো। নামকরণে যত স্বীকৃতি, তার থেকে ঢের ঋণাত্মক হলো সেই নামটি মুছে ফেলায়। আমাদের মানবিক গুণাবলির নিয়মিত অবনমনের ফলে আমাদের ধৈর্য কমেছে, পরমতসহিষ্ণুতা কমেছে, পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমেছে। গড়তে না হয় নাই পারলাম, মুহূর্তের খেয়ালে আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি।

বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সমাজের প্রতি ভালোবাসা অন্য সবার জন্য অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, হলগুলো কিংবা বঙ্গবন্ধুর নামে অন্য স্থাপনাগুলো কি গোটা জাতির জন্য, সমাজের জন্য অনুকরণীয় হয়েছে, না এগুলো নিছক অন্য যেকোনো স্থাপনার মতোই হয়েছে?

এখন দেশে প্রতিযোগিতা চলছে কত জায়গায় বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর নামের প্রতি সুবিচার করতে পারলাম কি না, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। এখন দেশে কমপক্ষে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধুর নাম ধারণ করে আছে। আছে গোটা চৌদ্দ হল। এগুলো সম্পর্কে ছোট-বড় নানা অনিয়ম ও নেতিবাচক খবর সংবাদপত্রে বের হচ্ছে এবং তাতে প্রথমেই আসে বঙ্গবন্ধুর নাম। এ রকম ক্ষুদ্র-তুচ্ছ বিষয়ের সঙ্গে নেতিবাচক খবরের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হওয়া কি যথাযথ? আমরা যদি একটি প্রতিষ্ঠানকে ওই উচ্চতায় তুলতে না পারি, তাহলে তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাম যুক্ত করা কি ঠিক হচ্ছে?

বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে তাঁর মতো দেশসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। তারপরও যদি আমরা চাই তাঁর স্মৃতি সদা জাগ্রত থাকুক, তাহলে তাঁর নামে বড় কোনো স্থাপনা তৈরি করতে পারি, একটি শহর তৈরি করতে পারি, যেমন আছে ভিয়েতনামে। প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় একটি স্থানের নাম মুজিবনগর রেখে শুধু যে তাঁকে গৌরবান্বিতই করা হয়েছিল, তা নয়, তাঁকে আমাদের সদ্য সৃষ্ট দেশের ইতিহাসের সাক্ষী করা হয়েছিল। তাঁকে আমরা একটি আধুনিক নগরীতে রূপান্তর করে সব শহরের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ তৈরি করতে পারতাম।

বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে মূল্যবোধ, দেশপ্রেম, সমাজের প্রতি ভালোবাসা অন্য সবার জন্য অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, হলগুলো কিংবা বঙ্গবন্ধুর নামে অন্য স্থাপনাগুলো কি গোটা জাতির জন্য, সমাজের জন্য অনুকরণীয় হয়েছে, না এগুলো নিছক অন্য যেকোনো স্থাপনার মতোই হয়েছে?

অতীতে হিন্দু-মুসলমান জমিদারেরা গ্রামে বিদ্যালয় তৈরি করতেন, নাম রাখতেন নিজেদের বাবা, মা কিংবা দাদার নামে। নিজের নামের প্রশ্নই উঠত না। এখন যোগ্য দাদা, বাবা, চাচার অনুপস্থিতিতে নিজের নামেই এসব প্রতিষ্ঠান করা হয়।
আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধুর নাম যেকোনো স্থাপনা কিংবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করতে হলে এর যথার্থতা প্রথমে নিরূপণ করা উচিত। উদ্যোগী ব্যক্তিদের কর্মকাণ্ড সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, মানবিক মূল্যবোধে তাঁরা গ্রহণযোগ্য কি না, পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা স্রোতে মিশে যান কি না এবং স্থাপনা কিংবা প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কি না, এগুলো বিচার করা উচিত।

শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন পেশার নিবেদিতপ্রাণ বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব, যাঁরা তাঁদের দক্ষতা দিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে জাতি গঠনে প্রশংসনীয় অবদান রেখেছেন, তাঁদের কথাও আমরা যেন ভুলে না যাই। সম্প্রতি আইসিটি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ইরানের আমির কবির ইউনিভার্সিটি একটি সুপার কম্পিউটার তৈরি করেছে। পরবর্তী সুপার কম্পিউটারের কাজেও তারা হাত দিয়েছে, যা হবে এক শ গুণ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং যার নামকরণ হয়েছে প্রয়াত একমাত্র নারী ফিল্ড পুরস্কার বিজয়ী মরিয়মে মির্জাখানির নামে।

আশা করি আমরা মানবিক মূল্যবোধে উন্নত হব। আমাদের নেতারা স্বীয় স্বার্থ তুচ্ছ করে সব জাতীয় প্রয়োজনে, অগ্রগতিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবেন, মুহূর্তের খেয়ালে ধ্বংস নয়, জাতির উন্নয়নে সংকল্পবদ্ধ হয়ে আমরা কাজ করব।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ফেলো