নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যুর দায় কেউ নেয় না

নিরাপত্তা সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করছেন নির্মাণশ্রমিক। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ১-এফাইল ছবি: প্রথম আলো

বহুতল ইমারত নির্মাণের পসরা এখন সবখানে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নির্মাণশ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি। প্রায় প্রতিদিনই নির্মাণশ্রমিকের নিহত আহত হওয়ার খবর আসে। সেসব খবরে থাকে নির্মাণাধীন কোনো স্থাপনার ছাদ ধসে পড়ে কারও মৃত্যুর খবর, কেউবা প্রাণ হারান অনেক উঁচুতে ঝুলন্ত অবস্থায় কোনো সেফটি গার্ড না থাকার কারণে দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে যাওয়ায়, কিংবা নিচ থেকে মালামাল দড়ি দিয়ে বেঁধে ওপরে তুলতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে নিচে পড়ে। তা ছাড়া ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎ ওপর থেকে পাথর কিংবা ইটের টুকরো অথবা লোহার রড মাথার ওপর পড়ে প্রাণ হারানোর খবর নতুন কিছু নয়।

খোদ ঢাকা শহরে গত সেপ্টেম্বর মাসে ১৭ দিনের ব্যবধানে ছয়জন নির্মাণশ্রমিক বহুতল ভবন থেকে পড়ে লাশ হয়ে গেছেন। রাজধানীর ভাটারা এলাকার প্রথম ঘটনা সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের (ঢামেক) পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সংবাদকর্মীদের জানান, আসাদুল ও তাঁর চাচাতো ভাই খায়রুল একটি নির্মাণাধীন ভবনের নবম তলায় কাজ করছিলেন। সেখান থেকে দুর্ভাগ্যক্রমে পড়ে গেলে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে নজরুল নাকি মালিবাগ এলাকায় কোনো এক পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় কাজ করার সময় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তাঁকেও ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পেছনে আহসানিয়া মিশনের পাশের একটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবন থেকে পড়ে তিন শ্রমিক মারা যান গত ২৮ সেপ্টেম্বর। মারা যাওয়া শ্রমিকদের মধ্যে শরিফুল (২৫) নামের একজনের পরিচয় জানা গেছে। ঘটনাস্থলেই শরিফুলের মৃত্যু হয়। বাকি দুজনকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁদেরও মৃত্যু হয়। তাঁদের নাম–ঠিকানা জানা যায়নি। তবে তাঁরা তিনজনই নির্মাণশ্রমিক হিসেবে ওই ভবনে কাজ করছিলেন বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ

প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীতে কোনো না কোনো নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছেই। এ মৃত্যুর ঘটনা দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ঘটছে। এগুলো নিতান্তই উদাহরণমাত্র। কোভিডের মধ্যেও গত নয় মাসে সারা দেশে বাড়ি নির্মাণ ও ভাঙার কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ হিসাব সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের যোগফলমাত্র। এর বাইরেও অনেক মৃত্যু ও আহত হওয়ার খবর নিশ্চয় আছে। নির্মাণশ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলে ইমারত শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব)। তাদের সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৭৩৯ জন নির্মাণশ্রমিক কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। ইনসাবের হিসাব অনুযায়ী গত ১৫ বছরের গড় করলে বছরে কমবেশি ১২০ জন নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু ঘটছে তাঁদের কর্মস্থলে কাজ করার সময়। সেই হিসাবের প্রায় দ্বিগুণসংখ্যক নির্মাণশ্রমিক নিহত হয়েছেন করোনাকালে। তবে কি কর্মহীন মানুষ সব ঝুঁকি ভুলে পেটের দায়ে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন? নাকি করোনাকালে দুপয়সা বাঁচানোর অছিলায় নিয়োগদাতারা আরও নির্মম আচরণ করছেন?

নির্মাণ খাত আমাদের অর্থনীতির এক তেজি খাত। নানা প্রণোদনা আর কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা করে সরকার এই খাতে বিনিয়োগের নানা অলিগলি বাতলে দিয়েছে। নগরকেন্দ্রিক আবাসন সমস্যা নিরসনের জন্য রাজধানী মহানগর থেকে জেলা শহর, এমনকি উপজেলাতেও চলে যাচ্ছে ‘ডেভেলপার’রা। ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ-এর হিসাব অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় নিয়োজিত ৩৮ লাখের মতো শ্রমিক এবং এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে, শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে—এমন সংস্থাগুলোর হিসাবমতে, নির্মাণকাজে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ শ্রমিক মারা যান নির্মাণস্থলে উঁচু থেকে নিচে পড়ে, ৭ থেকে ৮ শতাংশ শ্রমিক মারা যান আগুনে পুড়ে ও চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে এবং প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক দুর্ঘটনায় হাত-পা কেটে যাওয়া, আঙুল কেটে পড়ে যাওয়া বা এমন নানা মাত্রার অঙ্গহানির শিকার হয়ে থাকেন।

সরকারি ও বেসরকারি সব পর্যায়ে কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালে জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নীতিমালা ২০১৩ প্রণয়ন করে। কিন্তু এ নীতিমালা কেউ মানে বলে মনে হয় না।

মজার ব্যাপার, অতি লাভজনক এই খাতের প্রধান উপাদান শ্রমিকেরা সবাই অস্থায়ী। ইমারত নির্মাণের কোম্পানিগুলো মূলত ঠিকাদারদের মাধ্যম শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে থাকে আর শ্রমিকদের আয় থেকে একটি অংশ নিয়মিতভাবে নিয়ে নেন ওই ঠিকাদারেরা। কিন্তু দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে কিংবা পরে হতাহত শ্রমিকদের দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ থাকে না। সবাই তখন অচেনা হয়ে যায়। ধানমন্ডিতে দিনেদুপুরে তিনজন শ্রমিক উঁচু ইমারত থেকে ঝুপ ঝুপ করে পড়ে মারা গেলেন; কেউ তাঁদের নাম বলতে পারে না! কেউ জানায়নি ইমারতের মালিকের নাম। কোথাও সে কথা ছাপা হয়নি। কেউ জানে না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বা ডেভেলপারের হালসাকিন। নিহত–আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে কেউ দাঁড়াতে চাইলে এই তথ্যগুলো খুবই প্রয়োজন। নিয়োগপত্র দূরে থাক, এমনকি কোনো মাস্টাররোলও থাকে না। এ কারণে মৃত বা আহত ব্যক্তি যে কথিত ইমারতেই কাজ করতেন, সেটা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে বিজয় সরণিতে র‌্যাংগস ভবন ভাঙার কাজের সময় নিহত শ্রমিকদের লাশ গুম করে দেওয়ার ঘটনা আগ্রহী পাঠকদের মনে থাকতে পারে। দীর্ঘ পাঁচ মাস পর সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় শহীদুল ইসলামের কঙ্কাল। বহুল আলোচিত র‌্যাংগস ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে ছিল এ লাশ।

শ্রম আইন অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব নিয়োগকারীদের। ইমারত নির্মাণ আইন-১৯৫২, জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৬, ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা-২০০৮ প্রভৃতি আইন ও বিধানে নির্মাণশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা আছে। এ ছাড়া শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণের সময় চারপাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী দিতে হবে। উঁচু স্থানে কাজ করার সময় লিফট, সেফটি বেল্ট, শক্ত দড়ি-মাচা ব্যবহার; কাজের সময় মাথায় হেলমেট, পায়ে গামবুট ও মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। নির্মাণ ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এই খাতে কোনো বিনিয়োগ করে না।

নির্মাণকাজে প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম রাখতে হবে এবং সেফটি রেকর্ড বুক সংরক্ষণ করতে হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের উদাসীনতা, নজরদারির অভাব এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতা বড়ই পীড়াদায়ক। কিছু না হোক ডেভেলপার/ঠিকাদার সকালে কাজ শুরুর আগে শ্রমিকদের নাম–ঠিকানা তাঁদের মোবাইল থেকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান দপ্তরে পাঠিয়ে দিতে পারেন। বেঘোরে মরলেও নামটা তো কথাও খুঁজে পাওয়া যাবে, আর আমরাও আরেকটু ডিজিটাল হওয়ার মওকা পেলাম।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক

[email protected]