নির্মাতার কাঁধে দায় চাপাচ্ছেনরানা

এই খুঁটি দুর্বল ঢালাইয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে
এই খুঁটি দুর্বল ঢালাইয়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে

পুলিশ সূত্রমতে, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে সোহেল রানা দাবি করেছেন, ১০ তলা ফাউন্ডেশন আছে জেনেই তাঁরা ছয়তলার পর পৌরসভার কাছ থেকে ১০ তলা করার অনুমোদন নিয়েছিলেন। পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইঙ্গিত দেন যে আবদুল খালেক ও রানা নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান তন্ময় হাউজিংয়ের ওপর দায় চাপাতে পারেন।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ও প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ফাউন্ডেশনের কারণে দুর্ঘটনা ঘটার কোনো লক্ষণ নেই। অনুমোদনগত বৈধতার প্রশ্নও অবান্তর। বাস্তবে কোন তলায় কে কী ধরনের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে কারা কীভাবে ভবনটি তৈরি করেছে, সেটি বের করতে হবে। তাঁরা ওপরের দিকের কলাম বা খুঁটি নির্মাণে গলদ এবং ভারী শিল্প হিসেবে ভবন ব্যবহারকে দায়ী করেন। এখনো জানা যায়নি যে, তন্ময়কে তাড়ানোর পর নির্মাতা কে বা কারা?

স্থপতি মোবাশ্বের বিস্ময় প্রকাশ করে গতকাল বুধবার বলেন, ‘এখন আমরা জানছি এটি নির্মাণে ১০ তলা ফাউন্ডেশনের চুক্তি হয়েছিল। অথচ দুর্ঘটনার  পরে কোনো তদন্ত কমিটি তা খতিয়ে দেখেনি। কে কী চুক্তি বা নকশা করেছে, তা বড় বিবেচ্য নয়। বাস্তবে কত তলার ফাউন্ডেশন হয়েছে সেটা পরীক্ষা ছাড়া নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।’

উল্লেখ্য, কী ধরনের ফাউন্ডেশন হবে, তা মাটি পরীক্ষার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কাঠামো প্রকৌশলী নির্দিষ্ট করেন। এখনো এই প্রতিবেদনের হদিস মেলেনি। নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান তন্ময়ের নিয়োগ করা কনসালট্যান্ট বাস্তুকল্প আর্কিটেক্টস লিমিটেডের পক্ষে ছয়তলার কাঠামো প্রকৌশলী ছিলেন আবদুস সালাম। তিনি খুলনা থেকে ঢাকায় এসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাত সদস্যের তদন্ত কমিটির সামনে বক্তব্য রেখেছেন। বাস্তুকল্পের নির্বাহী প্রধান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক নাজিমউদ্দিন প্রতিবেদককে বলেন, ‘মাটি পরীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁরা নকশা করেছিলেন, কিন্তু তার রেকর্ড তাঁদের ফাইলে নেই।’ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে রাজউক বুয়েটের উপাচার্যকে কমিটি গঠনের অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে। আদালত থেকেও আদেশ পেয়েছে বুয়েট। তিন সদস্যের কমিটির প্রধান বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. আহসান উল কবির গতকাল বুধবার প্রতিবেদককে বলেন, ‘ঠিক তদন্ত নয়, আমরা বিশ্লেষণ করব। রানা প্লাজার নকশা এখনো পাইনি।

আড়া ও খুঁটির সংযোগস্থান নাজুক থাকার কারণে খুলে গেছে
আড়া ও খুঁটির সংযোগস্থান নাজুক থাকার কারণে খুলে গেছে

সেনাবাহিনীর কাছ থেকে কলাম, বিম ও স্ল্যাবের নমুনা পেয়েছি। কত তলার ফাউন্ডেশন আছে, তা এখনো অজানা। রিপোর্ট দিতে দুই সপ্তাহ সময় লাগবে।’ একদল বিশেষজ্ঞ তন্ময় হাউজিং লিমিটেডের ব্রশিউরে মুদ্রিত নকশা দেখে বলেছেন, এটা ছয়তলার। ভবনটির উচ্চতাসংক্রান্ত তথ্য তাতে নেই।  

ঢাকার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, প্রথমে ছয়তলা ও পরে ১০ তলায় উন্নীত করার উভয় ক্ষেত্রে সাভার পৌরসভা ‘কাঠামোগত নকশার দায়দায়িত্ব নেব না’ উল্লেখ করে অনুমোদন দিয়েছে। রানা প্লাজা নির্মাণে ২০০৬ সালের ১০ এপ্রিল ছয়তলার এবং ২০০৮ সালে সাততলা থেকে ১০ তলা পর্যন্ত অনুমোদন দিয়েছিল। পুলিশ সুপার এই অনুমোদনকে ‘প্রশাসনিক’ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, ভবন নির্মাণে এই অনুমোদন নেওয়া বা না নেওয়া প্রচলিত আইনে ঠুনকো বিষয়। রানা প্লাজা ছয়তলার নকশা পাস করিয়েও ১০ তলা করতে পারে। এমনকি প্রথমে ছয়তলার ফাউন্ডেশন দিয়ে পরে তা আরও বাড়ানোর প্রযুক্তিও আছে। বাংলাদেশে এর ব্যবহার অবশ্য বিরল।

রানাদের সঙ্গে তন্ময়ের ২০০৩ সালের চুক্তিপত্রে বলা আছে, ‘নির্মাতা তাঁর একক ব্যয়ে ১০ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বেজমেন্ট ও বেজমেন্টের ওপর পাঁচতলা ইমারত নির্মাণ করবেন। স্থপতি দ্বারা ডিজাইন প্রস্তুত ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্বারা উক্ত নকশা অনুমোদনের একক দায়িত্ব ডেভেলপারের।’ ‘কিন্তু তন্ময়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আমাদের কোনো লিখিত চুক্তি হয়নি,’ এই মন্তব্য করেন স্থপতি এস এম নাজিমউদ্দিন।

প্রথম আলোর সংগ্রহে রয়েছে সাভার পৌরসভার ২০০৬ সালের হাতে লেখা অভ্যন্তরীণ নোট। এতে দেখা যায়, ২০০৫ সালে তন্ময় হাউজিং ছিল  ছয়তলার ও ২০০৮ সালে ১০ তলার আবেদনকারী ছিলেন আবদুল খালেক। ২০০৬ সালে ছয়তলার অনুমোদন প্রদানে নোটের শেষ বাক্য: ‘কাঠামোগত ডিজাইনের দায়দায়িত্ব না রেখে লে আউট প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।’ ২০০৮ সালেরও হাতে লেখা নথির শেষ বাক্য: ‘কাঠামোগত ডিজাইনের দায়দায়িত্ব না রেখে দাখিলকৃত নকশা অনুযায়ী লে আউট প্ল্যান অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।’ কিন্তু রাজউকের অনুমোদিত কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন সরকারি বিশেষজ্ঞ দাবি করেন, ‘পৌরসভার জন্য বলবৎ কোনো আইনেই ওই নকশা অনুমোদনের এখতিয়ার সাভার পৌরসভার ছিল না। কারণ, এলাকাটি রাজউকের।’ পৌরসভার নোটেও এর স্বীকৃতি আছে। তারা  লিখেছে, আবেদনকারী ‘ডিআইটির’ কাছ থেকে নকশার অনুমোদন নেয়নি। রাজউক চেয়ারম্যান মো. নূরুল হুদা তাঁর দপ্তরে এই প্রতিবেদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘আইনি দ্বৈততার’ কথা জোর দিয়ে বলেন। ৬ মে তাঁর কাছে নির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সাভার পৌরসভার অনুমোদিত নকশাগুলো দেখিনি। এটা চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে পত্র লিখেছি।’ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শুধু নোটের ওপর অনুমোদন হয়নি। নোটে ২৪ কপি ব্লু প্রিন্টের কথা আছে। অনুমোদিত সেই ব্লু প্রিন্ট খুঁজে পেলে নেপথ্যের প্রকৌশলী কুশীলবকে ধরা যাবে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালের মহাপরিকল্পনা এবং ২০১০ সালে রাজউকের জারি করা ড্যাপে রানা প্লাজা এলাকাটি আবাসিক হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। পৌরসভা আইনে মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকায় ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনে পৌরসভাকে এখতিয়ারও দেওয়া হয়নি। অথচ রাজউক রানা প্লাজা ধসের পরপরই এ বিষয়ে যে অভ্যন্তরীণ নথি প্রস্তুত করে, তাতে পৌরসভা আইনে ভবন নির্মাণের অনুমোদন ক্ষমতাকেই তারা চিহ্নিত করে। দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে দুর্ঘটনার দিনই জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, সাভার যে রাজউকের অন্তর্ভুক্ত, তা তাদের ওয়েবসাইটেই দেখানো আছে।

সাভার পৌরসভার অভ্যন্তরীণ নথি
সাভার পৌরসভার অভ্যন্তরীণ নথি

ছয়তলা রানা প্লাজার মূল নির্মাতা কাজী সায়ফুল ও এর কাঠামো প্রকৌশলী মো. আবদুস সালামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট আয়োজিত শুনানিতে নাজিমউদ্দিন জানান, সালামের সূত্রেই তিনি সায়ফুলের সঙ্গে পরিচিত হন। প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ১০ তলা ফাউন্ডেশন দেওয়া নিয়ে তন্ময়ের কারও সঙ্গে তাঁদের কখনো কথা হয়নি।

১৫ মে আবদুস সালামও তা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘সায়ফুলের কথামতো আমি বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ছয়তলা ভবনের কাঠামো নকশা করেছিলাম। এরপর কখনো খবর রাখিনি যে রানা প্লাজা কত তলা হয়েছে।’ বাস্তুকল্পের পক্ষে রানা প্লাজার স্থাপত্য নকশা করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এ টি এম মাসুদ রেজা। তিনি বলেন, ‘কাজী সায়ফুল আমাদের কেবলমাত্র ছয়তলা ভবন নির্মাণেই নিয়োগ দিয়েছিলেন।’

চুক্তিতে আছে, বহুতল ভবনের ৬১ ভাগ কাজী সায়ফুল ও ৩৯ ভাগ প্রথম পক্ষ অর্থাৎ জমির তিন মালিক খালেক, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে পাবেন। প্রস্তাবিত বহুতলবিশিষ্ট ভবনের বেজমেন্টে গাড়ি পার্কিংসহ মার্কেট, গ্রাউন্ড ফ্লোর, দ্বিতীয় তলা ও তৃতীয় তলায় (ফার্স্ট ও সেকেন্ড ফ্লোর) সম্পূর্ণরূপে মার্কেট এবং চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় ব্যাংক/অফিস/ গার্মেন্টস হিসেবে ব্যবহূত হবে। এ থেকে ধারণা করা চলে, গোড়াতেই খালেক-রানার লক্ষ্য ছিল গার্মেন্টস বসানোর।

এটা পরিষ্কার যে ছয়তলার কাজ শেষ করা পর্যন্ত কাজী সায়ফুল রানা প্লাজা নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। চুক্তিতে আছে, ‘তফসিল সম্পত্তির ওপর সম্পূর্ণ বেজমেন্ট হয়ে গেলে ছাদ ঢালাইয়ের পরই আবদুল খালেক, রানা ও তাঁর মা তাঁদের ৫০ শতাংশ জমির মধ্য থেকে ৬১ ভাগ অর্থাৎ সাড়ে ৩০ শতাংশ জমি সায়ফুলকে সাফকবলা দলিল সম্পাদন ও নিবন্ধন করে দেবেন।’ এমনকি চুক্তিতে এও লেখা হয় যে সেই দলিল প্রস্তুত করার খরচ সায়ফুল বহন করবেন। কিন্তু এই জমি তাঁকে কখনো দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না।

চুক্তিতে আরও লেখা হয়, ‘সায়ফুলের একক ব্যয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম তলা (থার্ড ও ফোর্থ ফ্লোর) সম্পূর্ণরূপে ব্যাংক/অফিস/গার্মেন্টস হিসেবে ব্যবহার ও ভাড়া/পজেশন প্রদানের জন্য ওপেন স্পেস হিসেবে নির্মিত হয়ে হস্তান্তর হবে।’ এটা বাস্তবে কতটা ঘটেছে, তা স্পষ্ট নয়। তবে ছয়তলা হওয়ার পরেই কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা চালু করা হয়।

২০০৩ সালে চুক্তি সম্পাদনের সময় রানা প্লাজার জমি ব্যাংকে বন্ধক ছিল। তাই শর্ত ছিল, তন্ময় হাউজিংকে সাড়ে ৩০ শতাংশ জমির দলিল নিবন্ধনের আগেই খালেক ব্যাংক থেকে তাঁর জমি বন্ধকমুক্ত করবেন। কিন্তু তা আদৌ কখনো করা হয়েছে কি না, তা জানা যায় না। রানা প্লাজা গড়তে ২০০৬ সালে জমি বন্ধক রেখে যমুনা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন সায়ফুল। তবে যমুনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল আলম এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সায়ফুলকে নয়, ছয়তলা গড়তে আবদুল খালেককে আমরা ঋণ দিয়েছিলাম।’ আগামীকাল পড়ুন: যমুনা ও এক্সিমের ৫ কোটি টাকা

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।