নেপালকে স্বস্তি দিতে পারল না কমিউনিস্টরা

শাসক দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির দুই প্রধান নেতা কেপি শর্মা ওলি ও পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ড

নেপালের চলতি রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে তিনটি অনুমান সামনে আসে। প্রথম অনুমান, চীন-ভারতের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটি। পরের অনুমান, জনতা বিস্তর সুযোগ দেওয়ার পরও ক্ষমতাসীন সাম্যবাদীরা দেশকে স্থিতিশীলতা দিতে পারল না। এই দুই অনুমানের অন্তত একটি সঠিক। কোনটি ভুল তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তৃতীয় অনুমানটি নিয়ে আমরা বরং লেখার শেষে আলাপ করি।

এক দল: দুই কেন্দ্রীয় কমিটি

নেপালে গত সপ্তাহে যা হলো তার অর্ধেক প্রত্যাশিত, বাকিটুকু ছিল নাটকীয়তায় ভরপুর। শাসক দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (এনসিপি) দুই প্রধান নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ড ও কেপি শর্মা ওলির মধ্যে ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল গত এক বছর। ফল হয়েছে একই দলে এখন দুটি কেন্দ্রীয় কমিটি দাঁড়িয়েছে। এর মাঝে ওলি হঠাৎ পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে বলছেন প্রেসিডেন্টকে। এটা হলো ঘটনার নাটকীয় অংশ। খারাপ ভাষায়, ‘রাজনৈতিক জুয়া’।

প্রধানমন্ত্রী ওলি পার্লামেন্ট রাখতে চাইছেন না, কারণ সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে চলেছিল দলের একাংশ। এ সিদ্ধান্তের পরই প্রচণ্ড গ্রুপ দলের বৈঠক ডেকে তাঁকে এনসিপির চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করে সেখানে মাধব কুমার নেপালকে বসিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, প্রচারমাধ্যমে এই গ্রুপের নাম হবে এখন ‘প্রচণ্ড-মাধব গ্রুপ’।

ওলির নেতৃত্বে অপর গ্রুপও বসে নেই। তারাও নতুন কমিটি করেছে, সেখানে অবশ্য প্রচণ্ডের অনেক সহযোগীকে বাদ দেওয়া হলেও তাঁকে রাখা হয়েছে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা অংশকেই মূল দলের নাম ও নির্বাচনী প্রতীক ‘সূর্য’ বরাদ্দ দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ২০১৭ সালের রাজনৈতিক দলবিধি অনুযায়ী, ৯০ দিনের মধ্যে সেই দাপ্তরিক লড়াইয়ের মীমাংসা হবে। যে দলে পুরোনো কেন্দ্রীয় কমিটির ৪০ ভাগ সদস্য থাকবেন, তারা ‘মার্কা’ পাওয়ার লড়াইয়ে এগিয়ে থাকবে। বাকিদের নতুন নামে নতুন দল হিসেবে সনদ নিতে হবে। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, পুরোনো দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে প্রচণ্ডদের প্রতি সমর্থন বেশি। জনতার সমর্থন কোন দিকে, সেটা স্পষ্ট নয়। তবে করোনার মধ্যে এপ্রিল-মেতে আরেকটি নির্বাচন মানেই দেশটিতে মহামারির বাড়তি সংক্রমণ।

ঘটনার প্রধান চরিত্র কেবল ওলি বা প্রচণ্ড নন

রাজনৈতিক কারণে আন্তর্জাতিক খবর হয়ে উঠলেও নেপালের ভেতরে প্রধান খবর আসলে ভাইরাস। মৃত্যু এড়াতে মরিয়া মানুষ। ছোট জনসংখ্যার মাঝেই সংক্রমণ আড়াই লাখ অতিক্রম করে গেছে। মারা গেছে প্রায় দুই হাজার মানুষ। এর মধ্যই শাসকদের রাজনৈতিক ভাঙা-গড়া-বৈরিতা নাগরিকদের দিক থেকে বিরক্তিকর। বিরক্তির পাশাপাশি হাস্যকর অনেক উপাদানও আছে এই অধ্যায়ে। যে বিরোধীরা এত দিন প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগ চাইছিলেন, পার্লামেন্ট বিলোপ এবং নতুন নির্বাচনের সিদ্ধান্তে তাদের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরাও প্রধানমন্ত্রীর পার্লামেন্ট বিলোপের সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হয়ে উচ্চ আদালতে গেছেন। বোঝা যাচ্ছে, সব বিরোধিতাই রাজনৈতিক নয়, পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করার চেষ্টা মাত্র। প্রায় ১৩টি রিট দায়ের হয়েছে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে ওলির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।

নেপালের এই অধ্যায়ের একমাত্র চরিত্র অবশ্য ওলি বা প্রচণ্ড নন। পুরো কমিউনিস্ট পার্টিই চলতি সংকটের জন্য দায়ী। পাশাপাশি দায় আছে চীন-ভারতেরও। দেশ দুটো নেপালের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মরিয়া হয়ে নানা কলকাঠি নেড়েছে দিনের পর দিন। এনসিপি সেসব সামাল দিতে পারেনি। বরং তার অংশ হয়ে দলের ভেতর একাধিক উপদল গড়েছে। লিপ্ত হয়েছে পারস্পরিক বিবাদে।

একটা দল যখন নিজ দলের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পরিকল্পনা নেয়, তখন সেটা স্বাভাবিক ঘটনা থাকে না। নেপালের রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা মনে করেন, এ সপ্তাহে যা কিছু ঘটেছে, তাতে বহু শক্তির ইন্ধন আছে। ওলি এসব মোকাবিলায় ব্যর্থ। সরকারের সিদ্ধান্তে নিজ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও শামিল করতে পারেননি বা চাননি। সরকারকে এক ব্যক্তিনির্ভর করে ফেলেছিলেন তিনি। আবার দলের নেতৃত্বও দখল করে রেখেছিলেন পূর্ণ মাত্রায়। অথচ ক্ষমতার শুরুতে স্লোগান ছিল এক ‘সুখী নেপালÑসমৃদ্ধ নেপাল’ গড়বেন।

আপাতত চীন ক্ষতিগ্রস্ত

আপাতত দেশটির রাজনীতির পরবর্তী অধ্যায় বিচারালয়ে নির্ধারিত হবে। প্রধান বিচারপতি জং বাহাদুর রানা নিজেকে বিতর্ক থেকে আড়াল করতে পার্লামেন্ট বিষয়ে রিটগুলো সংবিধানবিষয়ক বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবার বিচারপতিরা তাঁদের সিদ্ধান্ত জানাবেন। তাঁদের হাতে পার্লামেন্টের ভাগ্য যেটাই ঠিক হোক, দুই বড় প্রতিবেশী যে দেশটির ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে, সেটাই কাঠমান্ডুর টক-অব-দ্য-টাউন।

চলতি সংকটের মধ্যেই চীনের রাষ্ট্রদূত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন। চীনের দিক থেকে এনসিপিতে ভাঙন একধরনের পরাজয়। বহু চেষ্টা করেও তারা দলটির ভাঙন আটকাতে পারেনি। অনিবার্যভাবে তাতে ভারত লাভবান।

ওলির পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ডাক অবৈধ হলে এবং পার্লামেন্টের অনাস্থা ভোটে হেরে গেলে তাঁকে ক্ষমতা হারাতে হবে। সে ক্ষেত্রে নতুন সরকার গঠনে চালকের আসনে থাকবে নেপালি কংগ্রেস। প্রচণ্ড গ্রুপকে কংগ্রেসের সমর্থনের জন্য ভারতের প্রিয়ভাজন হতে হবে। সে রকম সরকার হলে কেবল ওলি নন, তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার ‘অপরাধ’-এ প্রেসিডেন্টকেও অনাস্থা ভোটের মুখে পড়তে হতে পারে। আর এসব সমীকরণ যদি কাজ না করে, তাহলে দেশটি আবারও নতুন নির্বাচনে যাবে। সেখানেও চীন-ভারত উভয়কে গোপন যুদ্ধে সক্রিয় থাকতে হবে পছন্দসই শক্তিকে জিতিয়ে আনতে।

রাজনীতির লাগাম যখন কূটনীতিবিদদের কাছে

এনসিপির অনানুষ্ঠানিক ভাঙন থেকে চীন-ভারতের জন্যও খেলার ছক কিছুটা বদলে গেছে। চীনকে এখন এনসিপির ওলি অংশকে মদদ দিয়ে যেতে হবে। আর ভারত প্রচণ্ডপন্থীদের সঙ্গে নেপালি কংগ্রেসের জোটের জন্য সচেষ্ট হবে। অর্থাৎ আগামী মাসগুলোতে নেপালের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে যেসব ভাঙাগড়া চলবে, তার লাগাম থাকবে কূটনীতিকদের পাড়ায়।

চিত্রটি সাধারণ নেপালিদের জন্য সুখকর নয়। এর দায় প্রাথমিকভাবে পুরো এনসিপির ওপরই বর্তায়। দুই বছরও হয়নি, প্রচণ্ড ও ওলির নেতৃত্বাধীন দুটি দল মিলে এনসিপি গড়ে উঠেছিল। সংসদের ২৭৫ আসনে ঐক্যবদ্ধ দলের নিয়ন্ত্রণে আছে ১৭৩ আসন। নির্বিঘ্নে তারা আরও অনেক দিন ক্ষমতায় থাকতে পারত। রাজনীতিতে প্রবল কোনো বিরুদ্ধশক্তিও ছিল না। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, ব্যাপক জনসমর্থন থাকার পরও দলের দুই উপদল দেশকে টানাপোড়েনে রাখল প্রথম থেকে এবং নিজেদের দলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতেও ব্যর্থ হলো। এমনকি দল ও সরকারকেও আলাদা রাখতে পারেনি তারা। দলীয় কোন্দলকে সরকারের মাঝে টেনে নিয়ে গেছে, যা চূড়ান্ত বিচারে নেপালকে আবার রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে গেল।

কেন্দ্রীয় সরকারের এই টালমাটাল অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির প্রাদেশিক শাসন কাঠামো। সাতটি প্রদেশের ছয়টিতে এনসিপির সরকার রয়েছে। সেখানে প্রচণ্ডপন্থী ও ওলিপন্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যে। তাতে প্রাদেশিক সরকারের কার্যক্রম ভেঙে পড়তে বাধ্য। অন্তত তিনটি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী (বাগমাতি, গান্ধকি ও লুম্বিনি) ওলিপন্থী। কর্নালি ও সুদূর পশ্চিমে একই পদে আছেন প্রচণ্ডপন্থীরা। এদের বিবাদে প্রতি প্রদেশে বিরোধী নেপালি কংগ্রেসের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। সাম্যবাদীরা এক গ্রুপ আরেক গ্রুপকে ঠেকাতে গিয়ে নেপালি কংগ্রেসকে নিয়ে প্রাদেশিক সরকার গড়তে বাধ্য হবে অনেক স্থানে।

নেপালের ২-৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা এ–ও প্রমাণিত হয়, কমিউনিস্ট পার্টিতে বহু মত এবং যৌথ নেতৃত্বের চর্চা বাস্তবে এক অধরা মাধুরির মতোই। সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা’র যত ফর্মুলা থাকুক, এ ধরনের ক্যাডারভিত্তিক দল মূলত এক ব্যক্তি কিংবা এক ব্যক্তির প্রশ্নহীন অনুসারীদের দ্বারাই সচল ও জীবন্ত থাকতে পারে। নেপালবাসী অন্তত তা–ই দেখল।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক