নেপালে ব্যর্থতা মূলত সমাজতন্ত্রীদের

নেপারের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা

নেপালে কোর্টের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী হওয়া শের বাহাদুর দেউবা পার্লামেন্টে আস্থা ভোটেও জিতেছেন গত রোববার সন্ধ্যায়। ২৭১ সদস্যের পরিষদে বিভিন্ন দলের ১৩৬ জনের সমর্থন থাকলেই চলত তাঁর। পেয়েছেন ১৬৫ ভোট। বিপক্ষে ছিলেন ৮৩ জন এবং অন্যরা অনুপস্থিত ছিলেন।

এই ভোটের মাধ্যমে আগামী দেড় বছর ক্ষমতায় থাকার এখতিয়ার হলো শের বাহাদুর দেউবার। এরপর দেশটিতে নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে নেপালে কোনো সরকার সম্পর্কে এখন আর ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। মাত্র ৬১ সদস্যের সংখ্যালঘু দলের নেতা বলে দেউবার ভাগ্য অন্যান্য দলের হাতে ঝুলে থাকবে সব সময়ই। তাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আগের মতো অধরা থাকতে পারে সেখানে।

রাজনীতিবিদদের পারস্পরিক কোন্দলে কোনো দেশে কী রকম অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে, তার করুণ উদাহরণ নেপাল। কেবল গত এক দশকে দেশটিতে প্রধানমন্ত্রী পদে পরিবর্তন ঘটেছে ১১ বার। সর্বশেষ ১৩ জুলাই সেখানে প্রধানমন্ত্রী হন শের বাহাদুর দেউবা। এবারসহ পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি নেপালে। কৌতুক করে বলা যায়, নেপালে প্রথম সারির এমন রাজনীতিবিদ পাওয়া মুশকিল, যিনি কিছুদিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হননি। দেউবার আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কে পি শর্মা ওলি। তিনি এই পদে তিনবার দায়িত্ব পালন করেন। আরেক প্রধান রাজনীতিবিদ পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ড প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দুবার। লোকেন্দ্র বাহাদুর চান্দ ছিলেন চারবার। গিরিজা প্রসাদ কৈরালা ছিলেন পাঁচবার।

কৈরালা বেঁচে নেই আর। তিনি ছাড়া ওপরের তালিকার সবার ভবিষ্যতে আবারও এ পদে আসার সম্ভাবনা থাকছে। কিন্তু দেশটির নাগরিকেরা এ রকম ক্ষমতাবিলাসী অস্থিরমতি রাজনীতিবিদদের নিয়ে ক্লান্ত, বিরক্ত।

সর্বশেষ অবস্থায় চীন-ভারত দায় নেই
নেপালে সর্বশেষ অস্থিরতার কারণ জানতে আগ্রহী এ মুহূর্তে দক্ষিণ এশিয়ার সবাই। কোনো কোনো রাজনৈতিক ভাষ্যকার এতে চীন ও ভারতের ভূমিকা খুঁজে পান। উভয় দেশ নেপালকে ঘিরে অবশ্যই ঠান্ডাযুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু দেশ দুটি মোটেই চলতি অস্থিরতা তৈরি করেনি। ইন্ধনও দেয়নি। নেপালের রাজনীতিবিদেরাই চলতি দুর্ভাগ্যের উদ্যোক্তা। তাঁরাই দেশটির অস্থিরতায় চালকের আসনে ছিলেন এবং আছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে দেশটির বামপন্থীদের প্রধান অংশ। অথচ পুরো দক্ষিণ এশিয়া দারুণ এক সম্ভাবনা ও অর্জন নিয়ে তারা প্রান্তিক পাহাড়ি জনপদ থেকে গোলাগুলি থামিয়ে কাঠমান্ডুতে ঢুকেছিল ১৫ থেকে ১৬ বছর আগে। উপমহাদেশে বাম রাজনীতির ১০০ বছরের ঐতিহ্যে ওটা ছিল আকর্ষণীয় এক অধ্যায়। কিন্তু ইতিমধ্যে ওই একই সংগঠকদের আচরণে নেপালের ইতিহাসের অসাধারণ ক্ষণটি অনেকখানি ফিকে হয়ে গেছে।

হতাশ করেছে কমিউনিস্টরা
নেপালের সর্বশেষ পার্লামেন্টে ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির (এনসিপি) সদস্য ছিল ২৭৫ আসনের ১৭৪টিতে। ২০১৮ সালের ১৭ মে এ নামে সংযুক্ত হয়েছিল ‘ইউএমএল’ ও ‘মাওবাদী সেন্টার’ নামে প্রধান দুই কমিউনিস্ট দল। কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বে প্রথম দলটির আদর্শ ছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র নির্মাণ; পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ডের সঙ্গী মাওবাদীরাও সশস্ত্র পন্থা ছেড়ে এসে ক্রমে সেই আদর্শের দিকে ঝুঁকছিল।
পার্লামেন্টে ঐক্যবদ্ধ এই দুই উপদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাঁচ বছর নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, টেনেটুনে তিন বছরও পার করতে পারেনি তারা। ক্ষমতা হারিয়েছে এবং পার্টি ভেঙেও কয়েক খণ্ড হয়েছে। পার্টির নামটিও হারিয়ে গেছে। প্রত্যেক কমিউনিস্ট-উপদলের নেতাই গত কিছুদিন বিভিন্ন সমীকরণে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পাশাপাশি অপর উপদলের প্রধানকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করতেও ব্যস্ত হন। অপর পুরোনো কমরেডকে ঠেকানোর এই আত্মবিনাশী চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত যা হলো, দুই কমিউনিস্ট উপদলের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শের নেপালি কংগ্রেসের শের বাহাদুর।

অধঃপতিত রাজনীতির এক করুণ দৃষ্টান্তই বলতে হবে একে। এককালের মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল প্রচণ্ডের উপদল কংগ্রেসের দেউবাকে প্রধানমন্ত্রী হতে মদদ দিলেন সর্বশেষ। যে দেউবাকে নিজেদের সশস্ত্র শ্রেণিযুদ্ধের সময় প্রচণ্ডরা ‘খতম’ করতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলা হয় বহুকাল। নেপালে কমিউনিস্টদের রণকৌশলেও দেখা যাচ্ছে আদর্শিক কোনো দাঁড়ি নেই।

নেপালকে যন্ত্রণা দিচ্ছে সমাজ-রূপান্তরে অসমাপ্ত জের
নেপালের সর্বশেষ রাজনৈতিক সংকটের জন্ম ক্ষমতাসীন এনসিপির ভেতর দুই প্রধান নেতা প্রচণ্ড ও ওলির ক্ষমতালিপ্সা থেকে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ওলি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চেয়ে দলকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন। প্রচণ্ড চাইছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও দলের চেয়ারম্যানের একটি পদ ওলি তাঁকে ছেড়ে দিক। কিন্তু ওলি তাতে রাজি নন।

এককালের সশস্ত্র জনযুদ্ধের প্রধান হিসেবে প্রচণ্ডের জন্য এটা মান-মর্যাদার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা বিদ্রোহ করেন। ইতিমধ্যে ওলির ঘনিষ্ঠ শিবিরে মাধব কুমার নেপালের নেতৃত্বে আরেকটা ছোট বিদ্রোহ ঘটে। এভাবে দেশের প্রধান এই রাজনৈতিক দল এখন তিন খণ্ড। এই তিন খণ্ডের মধ্যে পার্লামেন্টে ওলি গ্রুপের শক্তি কমবেশি ১০০, প্রচণ্ডদের শক্তি ৪৯, মাধবদের শক্তি ২৩। এর বাইরে দ্বিতীয় দল হিসেবে আছে কংগ্রেস। পার্লামেন্টে তাদের আসন ৬১। জনতা সমাজবাদী পার্টি নামে তৃতীয় দলটির সদস্য হলো ৩২। শেষের এই দলেও দুটি উপদল আছে।
ওপরের তালিকার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দলটিতে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজনীতিবিদ বেশি। আর সমাজতন্ত্রীদের সব গ্রুপে সাধারণভাবে উল্টো অবস্থা। ঠিক এ কারণেই আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন নেপালের রাজনৈতিক সংকট ভারত-চীন বৈরিতার ফল। আপাত ভারত জিতেছে। কিন্তু কার্যত এটা দেশটিতে বিপ্লবী রূপান্তর অসমাপ্ত থাকার জের।

আরএসএসের নেপালি শাখা এইচএসএস (হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ)-কে দেশের সমতলে বেশ গুছিয়ে সংগঠন করতে দেখা যাচ্ছে। গত এপ্রিলে অতীত রাজা জ্ঞানেন্দ্র ভারতে গঙ্গার ধারে হরিদ্বারে এলে তাঁকে বিজেপি সমর্থকেরা ‘বিশ্ব হিন্দু সম্রাট’ হিসেবে সংবর্ধনা দেয়।

২০১৫ সালের সংবিধান নেপালকে সামন্ততন্ত্র, রাজতন্ত্র এবং ধর্মবাদী পরিচয় থেকে মুক্তি দিয়েছিল। পরিবর্তনের এই ঢেউকে শাসনকাজে নিয়ে আসার যে দায় ছিল, সেখানেই ব্যর্থ হয়েছে প্রথম সারির রাজনীতিবিদেরা। তাঁরা গত দেড় দশক পুরোনো আমলাতন্ত্র দিয়ে কাঠমান্ডুতে বসে পুরোনো আদলে দেশকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। ফলে, কমিউনিস্ট এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তির আমলেও নেপাল চলছিল রাজতন্ত্রের আদলে। এতে জনতা থেকে সংযোগ হারিয়ে শহুরে রাজনীতিবিদেরা ক্রমে সমর্থন খুঁজতে শুরু করেন কাঠমান্ডুর বিদেশি দূতাবাসপাড়ায়। সেসব অভিজ্ঞতা থেকেই সর্বশেষ ঘটনার গতানুগতিক বয়ান লেখা হচ্ছে আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায়।

চীনকে মোকাবিলায় নেপালে ভারত যেভাবে এগিয়ে
দেউবার দল নেপালি কংগ্রেস যে ভারতের ঘনিষ্ঠ, তা লুকোছাপা কোনো ব্যাপার নয়। সুতরাং অনেকে ভাবছেন আপাতত নেপালে চীনের রাষ্ট্রদূত হু ইয়াংকি দর্শক হয়ে গেলেন। কিন্তু বাস্তবে নেপালি কংগ্রেসের নেতা হলেও দেউবা মোদি বা বিজেপির ঘনিষ্ঠ নন। তাঁর পুরোনো সম্পর্ক ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে। এ ছাড়া পর্যবেক্ষকেরা সাম্প্রতিক আরও যে অগ্রগতিতে নজর হারিয়েছেন, তা হলো ওলি চীনের পুরোনো বন্ধু হলেও কিছুদিন ধরে ভারতের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব চলছিল। সে কারণেই ১৩ জুলাই দেউবা প্রধানমন্ত্রী হলেও নয়াদিল্লি থেকে তাৎক্ষণিক অভিনন্দন যায়নি। সেটা এসেছে ছয় দিন পেরিয়ে পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে জেতার পর।

সুদূর অতীত থেকে নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রীরা প্রথম শুভেচ্ছা নয়াদিল্লি থেকে পেতে অভ্যস্ত। এবার দেউবা সেটা পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের তরফ থেকে! যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে এত উৎসাহের কারণ অবোধগম্য নয়।

নেপালে তুমুল আলোচিত চীনা কূটনীতিবিদ হু ইয়াংকি যুক্তরাষ্ট্র (এবং ভারতেরও) বড় ‘বিরক্তি’র কারণ হয়ে উঠেছিলেন প্রায় আড়াই বছর। তাঁর আমলে নেপাল-চীন সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় চলে গিয়েছিল। কিন্তু বেশ খোলামেলাভাবে হস্তক্ষেপের পরও তিনি স্থানীয় কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারলেন না। ওলি ও প্রচণ্ডের রেষারেষিতে ক্ষতি বেইজিংয়ের। এরও গভীর সামাজিক কারণ আছে। নেপালের আরেক পুরোনো প্রধানমন্ত্রী বাবুরাম ভট্টরাইয়ের ভাষায় বলতে হয়, নেপালের সমাজের সমতল অংশে ভারতের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রভাব এত বেশি যে চীন কেবল মুদ্রা বা পণ্য সহায়তা দিয়ে সেটা পাল্টে দিতে পারবে না। গত ৩ মার্চ ‘দ্য প্রিন্ট’ প্রচারমাধ্যমকে বাবুরাম এ রকমই বলছিলেন।

বাবুরাম নেপালে পণ্ডিত রাজনীতিবিদ হিসেবে স্বীকৃত। তিনিও একবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই সাক্ষাৎকারের ১০০ দিনের মধ্যে তাঁর কথা হুবহু ফলে গেল। চীনের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের পছন্দের রাজনীতিবিদেরা দেশটির মন্ত্রিসভায় অভিভাবকের আসনহারা এখন। রক্তপাতহীন শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থান বলতে হবে একে। তবে এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে এবং দেউবা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মানে এ নয়, চীনের বদলে নয়াদিল্লির স্থানীয় অনুরাগীদের পছন্দ করছে নেপালিরা।

কেবল কমিউনিস্ট উপদলগুলো নয়, দেউবা বা নেপালি কংগ্রেসের হাতেও তেমন রাজনীতি ও সংগঠক নেই, যারা দেশকে স্থিতিশীলতা দিতে পারে। একদা মাওবাদীরা নেপালের সমাজকে রাজা আর ভূস্বামীদের হাত থেকে মুক্তি দিলেও অসমাপ্ত সেই বিপ্লব সমাজতন্ত্রের যেমন পথ দেখাতে পারেনি, তেমনি ধনবাদী পথের জন্য উপযুক্ত নেতৃত্বেরও জোগান দিতে পারছে না। নেপাল তাই আধাখেঁচড়া এক বিপ্লবের যন্ত্রণা বইছে। প্রতিবিপ্লবেরও প্রবল সুযোগ থাকছে যেখানে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট দেশের মাঝে চীন-ভারত ঠান্ডাযুদ্ধের উত্তাপ সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায় কাঠমান্ডুতে।

নেপালে নয়াদিল্লির হাতে অনেক ‘বিকল্প’ আছে। যেসবকে অতিক্রম করে ৯ শতাংশ বৌদ্ধ জনসংখ্যার দেশ নেপালে কেবল অর্থকড়ির জোরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য সহজ নয়। স্থানীয় সমাজতন্ত্রীদের প্রশাসনিক অদক্ষতা ও সংকীর্ণ ক্ষমতাবিলাস চীনকে মুশকিলে ফেলেছে।

ওলি প্রধানমন্ত্রী হওয়ামাত্র দেশটিতে ভারতের বিনিয়োগ কমে গিয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে ঠিক একই পরিমাণ। সুউচ্চ হিমালয়ের বাধা ডিঙিয়ে নেপালের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের দিকে এগোচ্ছিল চীন। অথচ একদা নেপালের একচেটিয়া বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল ভারত। উভয় দেশের সীমান্ত আজও প্রায় উন্মুক্ত। নেপালকে তাদের উভয়েরই খুবই দরকার। কিন্তু সাধারণ নেপালিদের দরকার উন্নয়ন ও সুশাসন। এবার হয়তো আবার ভারতের কিছু করার পালা!

প্রতিবিপ্লবের লক্ষণও আছে যেখানে
২০১৫ সালের সংবিধান নেপালকে এক আধুনিক রাষ্ট্রের পথ দেখায়। সময়ের হিসাবে ঠিক তখনই দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারত বৈরিতারও শুরু। দুই বড় প্রতিবেশীর চাওয়া-পাওয়াকে অতিক্রম করে রাষ্ট্রের চরিত্রকে ফেডারেল রূপ দিয়ে কমিউনিস্টরা দেশকে সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক রূপান্তরে এগিয়ে দিলেও একই নেতৃত্ব নেপালকে পরবর্তী অধ্যায়ে টেনে নিতে পারেনি। নিজেরা রাজনীতিতে কেন্দ্রবাদীই থেকে যায়।

এ পরিস্থিতি দেশটিতে দুই ধরনের পিছুটানের জন্ম দিয়েছে। পুরোনো রাজতন্ত্র এবং রাষ্ট্রের পুরোনো ধর্মীয় চরিত্র আবার জনগণকে টানছে। খোদ কমিউনিস্টদের একাংশ ওলির-উপদল ধীরে ধীরে আবার ধর্মীয় কাজে উৎসাহ জোগাচ্ছে। নেপাল এ পর্যন্ত যে ছয়জন সমাজতন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী দেখেছে, তার মধ্যে ওলিই প্রথম পশুপতির মন্দির গিয়েছেন। ভগবান রামের জন্মভূমি অযোধ্যা, না নেপালে, এ নিয়েও ভারতের সঙ্গে কৃত্রিম এক বিতর্ক করলেন ওলি গত বছর। ঠিক একই সময় গত ডিসেম্বরে নেপালজুড়ে বিক্ষোভ হলো পুরোনো হিন্দু রাজা জ্ঞানেন্দ্রকে আগের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার জন্য।

গণতান্ত্রিক রাজনীতির ব্যর্থতা থেকে এককালের অধঃপতিত রাজতান্ত্রিক ভাবাধারাকে ন্যায্যতা দেওয়ার বেশ সবল চেষ্টা দেখা যাচ্ছে ভ্যালিতে ইদানীং। ঠিক এই সুযোগেই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো নেপালকে ধর্মরাষ্ট্রে ফিরিয়ে নেওয়ার সামাজিক পাটাতন তৈরি করছে। আরএসএসের নেপালি শাখা এইচএসএস (হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ)-কে দেশের সমতলে বেশ গুছিয়ে সংগঠন করতে দেখা যাচ্ছে। গত এপ্রিলে অতীত রাজা জ্ঞানেন্দ্র ভারতে গঙ্গার ধারে হরিদ্বারে এলে তাঁকে বিজেপি সমর্থকেরা ‘বিশ্ব হিন্দু সম্রাট’ হিসেবে সংবর্ধনা দেয়।

এসবই মোদির আমলে ভারত-নেপাল সম্পর্কে নজর রাখার মতো নতুন উপাদান। নেপালে নয়াদিল্লির হাতে অনেক ‘বিকল্প’ আছে। যেসবকে অতিক্রম করে ৯ শতাংশ বৌদ্ধ জনসংখ্যার দেশ নেপালে কেবল অর্থকড়ির জোরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য সহজ নয়। স্থানীয় সমাজতন্ত্রীদের প্রশাসনিক অদক্ষতা ও সংকীর্ণ ক্ষমতাবিলাস চীনকে মুশকিলে ফেলেছে। কাঠমান্ডুতে প্রভাব হারিয়ে দেশটিতে বেইজিংয়ের বিপুল আটকে যেতে পারে। যেভাবে আফগানিস্তানে ঠিক এ সময়ই আটকে গেল ভারতের প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ। স্থানীয় সমাজের রসায়ন না বুঝে আমলা-কূটনীতিবিদদের দিয়ে অপর দেশে ভূরাজনীতি পরিচালনার কুফল হয়তো এসব।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।