ন্যাটোকে স্বমূর্তিতে আনা জো বাইডেনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ

জো বাইডেন

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের নাটকীয় কর্মকাণ্ডের অবসানের পর দ্য নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) আবার ‘স্বাভাবিক’ অবস্থায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্পের নেতিবাচক বাগাড়ম্বরিতায় ন্যাটোর ভাবমূর্তি ও প্রভাবের যতখানি ক্ষতি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, তা ফিরিয়ে আনা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে তাতে সন্দেহ নেই।

তবে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে আবার জোটগত সামরিক শক্তিতে উজ্জীবিত করতে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা ইউরোপীয় জোটকে আবার নতুন করে প্রাণশক্তি জোগাচ্ছে। ন্যাটো যে সংকট কাটিয়ে এই প্রথমবারের মতো ভগ্নদশা থেকে আবার নিজেকে শক্তিধর অবস্থায় আনার চেষ্টা করছে তা নয়। এর আগেও এ জোট বেশ কয়েকবার অস্তিত্বসংকটে পড়েছে এবং প্রতিবারই সংকট সামলে উঠতে পেরেছে।

এমনকি শীতলযুদ্ধের আগেও সুয়েজ খাল সংকট, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, কিউবান মিসাইল সংকট এবং জোটভুক্ত দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতায় আসা—ইত্যাদি ইস্যুতে গভীর সংকটে পড়েছে এবং প্রতিবারই তারা সংকট সামলে উঠেছে। আর শীতল যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কবল থেকে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয়তায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে যখন ইস্টার্ন ব্লক ভেঙে পড়ে, তখন সোভিয়েত ইউনিয়নকে দূরে রাখতে আমেরিকার সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের সম্পর্ক জোরালো হয়।

২০০১ সালে নাইন–ইলেভেন হামলার পর ন্যাটো আর্টিকেল ফাইভ (সদস্যভুক্ত দেশ আক্রান্ত হলে সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র অভিযান চালানোর অনুমতি দেওয়া অনুচ্ছেদ) অনুসরণ করে। তবে আফগানিস্তানের মতো এত দূরবর্তী এলাকায় দীর্ঘ সময় ন্যাটোর লড়াই চালিয়ে যাওয়া গোটা জোটের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একধরনের অবসাদ নিয়ে এসেছিল। তবে তাতে জোটের কোনো ভাঙন ধরেনি। বরং ট্রাম্প জমানার আগে পর্যন্ত সে ঐক্য বেশ অটুট ছিল এবং সদস্যসংখ্যা ১৬ থেকে ৩০-এ পৌঁছেছিল।

এ জোট নিজেদের মধ্যে বরাবরই বোঝাপড়া করে সব সংকট কাটিয়ে উঠেছে এবং আসন্ন ১৪ জুন ব্রাসেলসে জোটের যে সম্মেলন হওয়ার কথা, সেখানেও সদস্যদেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ট্রাম্পের হতাশামূলক আচরণে ইউরোপের নেতাদের মধ্যে যে হতাশা দেখা দিয়েছিল, ওই সম্মেলন জো বাইডেনের নেতৃত্বে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ সম্মেলনে তিনি সদস্যদেশগুলোকে এ বার্তা দেবেন, বিভক্তির চেয়ে ঐক্যের পথে থাকলেই জোটভুক্ত সবার লাভ হবে।

আমার মতে, নিজেদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ সম্প্রসারণে জোটকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ জোটে থাকা দেশগুলোতে প্রায় ১০০ কোটি মানুষের বাস এবং এ দেশগুলোর মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বিশ্বের মোট জিডিপির অর্ধেক। সুতরাং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলোর ক্লাবকে সুরক্ষিত রাখতে গেলে ন্যাটোকে তার বৈশ্বিক নেতৃত্বের জায়গায় যে ফিরতেই হবে, তা তারা বুঝতে পারছে।

এ মুহূর্তে ন্যাটোর সামনে প্রধান দুই চ্যালেঞ্জ হলো রাশিয়া ও চীন। সাইবার, স্পেস এবং ভূরাজনীতি—এ তিন দিক থেকে দেশ দুটো হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক ইস্যুতে ট্রাম্পের অনীহা প্রকাশের সুযোগে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বাড়িয়েছে। অন্যদিকে চীন গোটা এশিয়া অঞ্চলে একক আধিপত্যের পথে পা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিং ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে।

ইউরোপিয়ানরা চীনকে এখন শুধু অর্থনৈতিক প্রতিযোগীই নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে। তারা ইতিমধ্যে প্রযুক্তি খাত থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে চীনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করছে। তবে জো বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ভিন্ন লেন্সে দেখছে। এশিয়া চীনের একক আধিপত্যের চেষ্টাকে ওয়াশিংটন নিজের ভবিষ্যৎ প্রভাবের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে দেখছে। এ বিবেচনা থেকেই জো বাইডেন ন্যাটোকে আবার শক্তিশালী করে যুক্তরাষ্ট্রকে ফের ‘বৈশ্বিক’ করে তোলায় মনোযোগী হয়েছেন। তবে তিনি কতটা সফল হবেন, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

মারওয়ান বিশারা আল–জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক