পথ হারিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য

স্বৈরশাসকেরা পাশ্চাত্য শক্তিকে হাতে রাখার জন্য সন্ত্রাসবাদের হুমকি পয়দা করে দেখায় যে নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের কোনো বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্য যতই দুই ভাগে বিভক্ত এবং নতুন ও পুরোনো শক্তির সংঘাতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হচ্ছে, পশ্চিমারা ততই মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রহ হারাচ্ছে।

দা-কুড়ালের মতো বিপরীত বিশেষণে পরস্পরকে অভিযুক্ত করছে সবাই। যেমন—শাসক বনাম ইসলামপন্থী, যুদ্ধ ও সন্ত্রাস, ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম সাম্প্রদায়িকতা। এসব লেবেলকে প্রশ্ন করা না হলেও, এরা বরং আরও জটিল ও বিপজ্জনক বাস্তবতাকে ঢেকে রাখার খোলস হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দরকার পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপ অথবা স্বার্থবাদী উদাসীনতার বিকল্প খুঁজে বের করা।

ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও ব্রাসেলস থেকে ঘটনাবলি যতই উদ্ভট ও নৈরাজ্যজনক দেখাক, এই অঞ্চলের উন্মোচনে যতই মাথা ঘোরাক, মিসরে বাঁচার চেষ্টা করুন বা মরতে থাকুন সিরিয়ায়। বাইরে থেকে আমাদের দুর্ভোগে সমবেদনা জানানো কেবল অনৈতিকই নয়, রাজনৈতিকভাবেও অদূরদর্শী।

তথ্যপ্রমাণ দেখায়, শাসকেরা হতে পারে ভয়ংকর সহিংস এবং ইসলামপন্থী গোষ্ঠীরা মোটা দাগে শান্তিপূর্ণ। সেক্যুলাররা ধার্মিক, লিবারেলরা অগণতান্ত্রিক ও ভালোর মাত্রায় সংকীর্ণ এবং জেনারেলরা বেহায়া রকম স্বৈরাচারী। আবার এটাও দেখা গেছে, এর উল্টোটা কম সত্যি। আধুনিক মধ্যপ্রাচ্যে ব্যানার ও লেবেল দিয়ে কিছুই বোঝা যাবে না।

এ কারণেই বিভিন্ন লেবেলের প্রতি পাশ্চাত্যের প্রতিক্রিয়া যথাযথ হয় না। তাদের উচিত কিছু মৌলিক প্রশ্নও করা যে সিরিয়ার আসাদ কি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ছেন, নাকি তাঁকে গজিয়ে তুলতে সাহায্য করা হচ্ছে? মিসরের জেনারেল সিসি কি সংস্কারক, নাকি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিকৃতিসাধক? ইরান কি স্থিতিশীলতার মরূদ্যান, নাকি অস্থিতিশীলতার জোগানদাতা?


নিপীড়নের যুক্তি
ভয়ংকর সহিংসতার পেছনে কাজ করছে বিকারগ্রস্ত হিসাব-নিকাশ: যারা মুক্তি ও মর্যাদার জন্য ব্যাকুল, তাদের শাস্তি দাও এবং ভাবতে বাধ্য করো যে জালিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আসলেই বুদ্ধিমানের কাজ কি না। সিরিয়ার চলমান গণহত্যা, মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান আর লিবিয়ার বিপর্যয় দেখায় যে প্রতিবিপ্লব এখন পূর্ণবেগে ধাবমান। গণবিরোধী শক্তি সর্ব উপায়ে হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়া ও ধরে রাখার জন্য লড়ে যাচ্ছে।

আরব স্বৈরশাহী চেষ্টা করেছে সব ইসলামপন্থীকে চরমপন্থী, সহিংস এবং চূড়ান্তভাবে আল-কায়েদার সঙ্গে যুক্ত বলে দেখাতে। যখন এমনকি রক্ষণশীল ও অতিরক্ষণশীলেরাও যুগের হাওয়া মেনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে গেছে, তখন ‘সাবেকি শাসন’ অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে তাদের পরাস্ত করেছে—যেমনটা ঘটেছে মিসরে।

মিসরে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকার সময় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ব্যাপারে তাদের বোঝাপড়ার সীমাবদ্ধতাই দেখিয়েছে। তা হলেও, এই সীমাবদ্ধতা কোনোভাবেই সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিপর্যয়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়। মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ এবং পরে নিষিদ্ধ করা হলো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের লেবেল দিয়ে। এরপর তাদের সঙ্গে সমঝোতার আর কোনো পথ খোলা রইল না। অথচ মিসরের জনগণের তিন ভাগের এক ভাগই তারা। এ ঘটনাই মিসরকে এক পরিপূর্ণ নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

পশ্চিমা নেতারা হয়তো মিসরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে উল্টো পথে চালনা করা এবং জনগণের বড় একটি অংশকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ব্যাপারে অনুতাপ করেন, কিন্তু কোনো ফলদায়ক পদক্ষেপ নিতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। মিসরে সেনাশাসন কায়েম হওয়া তাঁরা ঠেকাতে পারেননি।

যুদ্ধের বীজগণিত

সিরিয়ায় আসাদ সরকার মোটামুটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনকে দমাতে দাবি করল যে তারা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। ‘সন্ত্রাসবাদের’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ এভাবে সমগ্র সিরীয়কেই সন্ত্রস্ত করে ফেলল। সচেতনভাবে, তারা সহিংস জিহাদিদের বাড়তে দিল এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের পূর্ব ঘোষণাও বাস্তবতা পেল। জিহাদিরাও শুরু করল হত্যা ও ধ্বংসের যুদ্ধ।

কিন্তু এখন দৈত্য ঠিকই বোতলের বাইরে চলে এসে সহিংস স্বৈরশাসক ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা এই অঞ্চলে আরও অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে চলেছে। শাসকগোষ্ঠী এখন যতই এদের দমনে ক্ষমাহীন বল প্রয়োগ করবে, ততই চরমপন্থা আরও বিস্তৃত হবে। আজ সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকে আল-কায়েদা শক্তি অর্জন করেছে।
দুঃখের বিষয়, ওয়াশিংটন ও লন্ডন এখন রাশিয়ার যুক্তি গিলছে যে আল-কায়েদাকে মোকাবিলা ও সন্ত্রাসবাদকে পরাস্ত করায় সিরিয়া সরকারের ক্ষমতাসীন থাকা প্রয়োজন।

ডান ও বামের অজস্র পশ্চিমা পণ্ডিত সুন্নি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ইরান ও ইরাকের শিয়া নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগের ওকালতি করছেন। এটা বুমেরাং হিসেবে প্রমাণিত হবে এবং এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক হানাহানি আরও বাড়িয়ে দেবে।
পশ্চিমা নেতারা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই তিন বছর আগে রাজপথ ও জনচত্বর থেকে ওঠা গণতান্ত্রিক দাবিগুলোর দিকে আবার তাকাতে হবে। যা ছিল স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও সামাজিক ইনসাফ।

যে দেশে বিকশিত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই, সেখানে একমাত্র গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রেখেই এই দুই ঘাটতি মেটানো সম্ভব। একইভাবে, গোটা অঞ্চলজুড়ে ন্যায়বিচারের পুনরুজ্জীবন ও গ্রহণমুখী গণতন্ত্রই হবে আরব দুনিয়ায় চলমান সহিংস চরমপন্থার প্রতিষেধক।


আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, সংক্ষেপিত অনুবাদ
মারওয়ান বিশারা: আল-জাজিরার জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক বিশ্লেষক।