পনেরোই আগস্ট ও আমাদের পরিবারে কিছু স্মৃতি

ডান থেকে হামিদা সেরনিয়াবাত, হাবিবা জামান, হাবিবা আলম, শেখ রোজী জামাল

আমার নানির নাম খাদিজা হোসেইন লিলি। উনি বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ছোট বোন। ১৫ আগস্ট এলেই নানির অনুভূতির কথা মনে পড়ে। নানি বলতেন যে ওনার ভাবির (বঙ্গমাতা) সঙ্গে উনি পান খাওয়ার প্রতিযোগিতা করতেন, কারটা বেশি লাল হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আমার নানি আর কখনো পান মুখে নিতে পারেননি।
নানির দুটি কথা খুব মনে পড়ে, আর তা এখনো আমার ভেতরটাকে কাঁপিয়ে দেয়। নানি বলতেন, ‘১৫ আগস্টে আমি এতিম হয়ে যাই। মিয়া ভাই (বঙ্গবন্ধু) প্রায় ভাবিকে বলতেন, রেনু, তোমার জন্য রাসেল যা, আমার জন্য লিলি তা। আমার ভাবি আমার সঙ্গী ছিলেন আর অনেক খেয়াল রাখতেন।’

আমার নানি ১৫ আগস্ট কেবল ওনার অভিভাবক হারাননি, এর আগে ১০ জুলাই ওনার মেয়ে পারভিন জামাল রোজীর বিয়ে হয়েছিল শেখ জামালের সঙ্গে। আমার রোজী খালা শহীদ হন ১৫ আগস্টের কালরাতে। আমার মা ও বাবার বিয়ে হয় ১৯৭৫ সালের ১০ আগস্ট। আমার মায়ের সঙ্গে শেষবারের মতো তাঁর বোনের দেখা হয় ১৪ আগস্ট রাত ১১টার দিকে।

১৫ আগস্টের পর আমার নানা সায়েদ হোসাইনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৭৭ সালে তিনি ছাড়া পান। আমার দাদা, নুরুজ্জামান, তখন পুলিশের এসপি ছিলেন এবং ওনার পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব ছিল, তিনি তা আমার নানার জন্য করেছেন। আমার দাদা আমার নানাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। আমার নানা সায়েদ হোসাইন তৎকালীন সংস্থাপণ মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র অফিসার ছিলেন।

জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আমার নানা তাঁর মেয়ে রোজীর লাশের খোঁজ করেন এবং এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানকে ফোন করেন। আজকে বনানী কবরস্থানে অনেকেই যান, কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে এই কবরগুলোকে চিহ্নিত করেছেন কে। আমার বাবা, ইঞ্জিনিয়ার শাহিদুজ্জামান ১৯৭৭ সালে একদিন ভোরে বনানী কবরস্থানে যান এবং বাঁশ দিয়ে কবরগুলোকে চিহ্নিত করেন। পরে ১৯৭৯ সালে কবরগুলোয় দেয়াল দেওয়া হয়।

গত ৪৫ বছরে কখনো আমাদের মা এবং বাবার বিবাহবার্ষিকী পালন করা হয়নি। এটা কোনো নালিশের বিষয় নয়। কারণ, আমাদের মনে পড়ে যায় আমার নানির কথা। পরশ দাদা (যুবলীগ চেয়ারম্যান) এবং তাপস ভাইয়ের (ঢাকা সাউথের মেয়র) এতিম হয়ে যাওয়ার কথা। তাঁরা বড় হয়েছেন তাঁদের চাচি ফাতেমা সেলিমের কাছে।

আমার এই মামির ত্যাগের কথা শুরু করলে আজ এখানে শেষ হবে না। তাঁদের চাচি ঘুম পড়াতেন তাঁদের মায়ের পছন্দের কিছু গান শুনিয়ে এবং নানাভাবেই উনি অনেক কিছু ত্যাগ করেন, যাতে করে পরশ দাদার এবং তাপস ভাইয়ার কোনো সময়ই তাঁদের মায়ের অভাবের কথা মনে না পড়ে যায়।

আরেকজনের বিষয়টি অনেকেই জানেন না। তিনি আমার বিউটি খালা(হামিদা সেরনিয়াবাত)। সেরনিয়াবাত নানার মেয়ে। উনি ১১ বার গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে আছেন সব হারানোর বেদনা নিয়ে। বিউটি খালা পরশ দাদা ও তাপস ভাইয়ার খালা ও ফুপু দুটোই।

বঙ্গবন্ধুর ছোট বোনের ছোট নাতি হিসেবে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, কিন্তু এই পরিচয় আমার অহংকার নয়। যত দিন ১৫ আগস্টের সব খুনির বিচার না হয়, তত দিন আমরা জাতি হিসেবে কলঙ্কমুক্ত হব না, অহংকার করে বলতে পারব না যে আমরা বাংলাদেশি।

বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসতে কোনো রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের দরকার নেই। বঙ্গবন্ধুকে যারা সম্মান দিতে পারে না ওনার ত্যাগ ও গভীর ভালোবাসার জন্য, তারা বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারে না।

হাসানুজ্জামান: কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি শিক্ষার্থী। বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে ছোট বোনের ছোট নাতি।