আব্দুল কাইয়ুম আওয়ামী লীগের কাছে দুটি প্রশ্ন রেখেছেন (প্রথম আলো, ২২ মে ২০১৩)। তার একটি হচ্ছে, কোনো বাবা কি তাঁর সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিতে পারেন? আমি জনাব আব্দুল কাইয়ুমকে একটা পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই: কোনো বাবা যদি তাঁর সন্তানকে বৃহত্তর কারণে উৎসর্গ করেন, তবে বেদনা কি কারও চেয়ে ওই বাবার কম? আমার লেখাটি জনাব কাইয়ুমের কোনো প্রতিক্রিয়া নয়। তবে তাঁর লেখা আমার লেখাটি তৈরির পেছনে খোরাক জুগিয়েছে বেশ।
ক্ষমতায় না যেতে পারলে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ভাবে, তাদের কিছু করার নেই। এমনকি নিছক আত্মশুদ্ধিও নয়। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবির কারণ ওই দলটি সঠিক গবেষণা করে দেখেছে বলে জানা যায় না। কিংবা ২০০১-২০০৬ সাল থেকে তারা কী কারণে ২০১৩-তে এসে আবার জনগণের আস্থাভাজন হতে চায়, তা-ও তারা তুলে ধরেনি। ভাবটা এমন, বিএনপি-জামায়াত জোটের ৩২টি আসন পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী ছিল। তাই তারা সংসদে যাওয়ার জন্য সরকারি দলের কৃপা চান—‘ধরো বন্ধু আমার কেহ নাই’। সুতরাং ‘আর কটা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি’র মতো একটা ভালো নির্বাচন বিএনপির একমাত্র ধ্যান। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে এ জন্য বিএনপি জোট আরও একবার ‘তত্ত্বাবধায়ক’-এ সওয়ার হতে চায়। আর সরকারি দল হয়তো খেয়ালই করেনি সাড়ে চার বছর চলে গেছে। তাই বিরোধী দলের হাঁকডাকে সংবিৎ ফিরেছে তাদের। কথা হচ্ছে নির্বাচনের ধরন নিয়ে।
জনদাবির মুখে বিএনপির অনিচ্ছাকৃত ছাড়ে ১৯৯৬ সালে প্রবর্তিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তাই ব্যবস্থাটিতে যত প্রকারের গলদ রেখে দিয়ে একটা ‘চান্স’ রেখে দেওয়াই ছিল উদ্দেশ্য। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে যতটা ক্ষমতাশালী করা যায়, সেদিকেই ছিল তাদের নজর। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুরের ভূমিকা অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করে, যার নির্বাচন-পরবর্তী পাঁচ বছরের ‘চলন’ প্রশ্নগুলোকে অভ্রান্ত অনুমানে রূপ দেয়। সংবিধানের ওপর সেরা বাটপারি করা হয় দলীয় বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করার মানসে বিচারপতিদের বয়স বৃদ্ধির বিধান করে আনা সংশোধনীর মাধ্যমে, ২০০৪ সালে। কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে ২০০৬ সালে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিনকে দিয়ে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একেবারেই নিজের করে নেয়। সেটাই ছিল ওই সরকারব্যবস্থার রাজনৈতিক মৃত্যু। পরে তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা সংসদ কর্তৃক বাতিল ছিল নিতান্তই একটি পরিণতি, ভাগ্যের ফেরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের হাতে। আর ব্যবস্থাটির বিচারিক মৃত্যু হয়েছে অনেকটা আলগোছে, কিন্তু অবধারিতভাবে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সংবিধান নতুন করে ছাপানো হলে ব্যারিস্টার মওদুদ বলেন, রায় অনুসারে সংবিধান ছাপানো বেআইনি; যা করার সংসদকে করতে হবে। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা হলে বলা হলো, কোর্ট তো আগামী দুটি জাতীয় নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে বলেছেন। অতএব, সংসদ এটা এখন বাতিল করতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক চাওয়া নয়, বরং এ কারণে চাওয়া যে ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তনে বিদায়ী সরকার আমাদের সমাজ মনস্তত্ত্বে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে। নির্বাচনে এর একটা সুবিধা পাওয়া যায় বৈকি।
বিএনপির এই ব্যর্থতার মিছিলে আওয়ামী লীগও যেন শরিক হতে চলেছে। আমার মতে, আওয়ামী লীগের বড় সমস্যা দুটি: (১) সরকার ও দলের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজনরেখা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হওয়া। (২) তারা একটা ভালো কাজ এমন প্রক্রিয়ায় করে যে তা জনগণের কাছে অশুভ হয়ে প্রতিভাত হয়। নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জও দ্বিবিধ—একটা অভ্যন্তরীণ, অন্যটা বাইরের। নিজেরা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে জিতে প্রকৃতভাবে নির্বাচনে জেতার স্বাদ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দল আস্বাদন করার তৃপ্তি পেতে পারে কি না, এটা হলো তাদের অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। আর বাইরের চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে, নিজেদের হাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব রেখে (বা সংসদকে জীবিত রেখে) এমনকি বিরোধী পক্ষ সমভিব্যাহারে কী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমান কার্যকরী স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনী কাঠামো তৈরি করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারা বলছে, কেউ কোনো পদ্ধতি বা রূপরেখা চালু করতে পারলে, জনগণ তার কৃতিত্ব তাকে দেয়। আওয়ামী লীগ সেখানে ভূমিকা রাখবে না কেন? এমনকি তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ভেতরে বড় বিতর্ক হওয়া উচিত ছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা একটা মোহ। এর নামের ও কাজের মধ্যে একটা চমৎকারিত্ব ও চটকদারিত্ব আছে। এটা প্যানাসি-ও নয়, পানদোরার বাক্সও নয়। কিন্তু এর প্রধান অসুবিধা হলো, ‘ভ্রম’ রোধে এটা সব দরজা বন্ধ করে দেয়, ‘সত্য’ তখন ঢোকার জায়গা পায় না। সর্বরোগের দাওয়াই না হলেও, জুতসই একটি নির্বাচনী দাওয়াই আসলেই আমাদের বড় দরকার। ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ এমনি এমনি বদল হয় না। আগামী দুবার তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হলে আমাদের গণতান্ত্রিক বনিয়াদ পাল্টে যাবে, এমন ধারণা অবান্তর। বরং ‘সংস্কৃতি’ বদল যদি করতে হয়, তবে এখন থেকে শুরু করতে হবে। কে হলফ করে বলতে পারবে আমরা সংসদীয় নির্বাচনী সংস্কৃতির অভিযাত্রায় সবচেয়ে উপযুক্ত সময়ে নেই? একটা শিশু এক-দেড় বছর পর হাঁটতে পারবে চিন্তা করে ওই শিশুকে হাঁটা অনুশীলন শুরু করা হবে না, তা কেমন করে হয়? রাজনৈতিক শক্তির পাশাপাশি সিভিল সোসাইটির উচিত ‘সংসদীয় নির্বাচন সংস্কৃতির’ ধারায় ফিরে যেতে রাজনৈতিক দলগুলোকে উৎসাহ দেওয়া। আওয়ামী লীগের উচিত নির্বাচন কমিশন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা, সংসদের বিলোপ প্রশ্ন ইত্যাদি নিয়ে একটা নির্বাচনী কাঠামোর যৌক্তিক ধারা তৈরি করা, যার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ধারণা একটা গ্রহণযোগ্য চেহারা পেতে পারে।
এস এম মাসুম বিল্লাহ: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
billah002@gmail.com