পাবলিকের পেটে ত্যালত্যালা লাথি

মাছ নিয়ে বাসের জন্য জেলেদের ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা
ছবি: প্রথম আলো

‘জু যাব! জু যাব!’ বলে কয়দিন ধরে ছোট ছেলে চেঁচাচ্ছিল। জুজুর ভয় দেখিয়েও তার ‘জু যাব!’ শীর্ষক স্লোগানমুখর দাবি দমানো যাচ্ছিল না। সেই দাবি পূরণে শুক্কুরবার সকালে দারাপুত্রপরিবার নিয়ে বের হলাম। গন্তব্য ‘জু’—মানে মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানা।

রাস্তায় নেমে দেখি শয়ে শয়ে মানুষ। বাস-টাস কিচ্ছু নেই। খানিকক্ষণ পরপর একটা–দুটো সিএনজি (জিনিসটা আসলে ‘সিএনজিচালিত অটোরিকশা’, কপালের ফেরে সবাই তাকে ‘সিএনজি’ নামে চেনে) আসছে। যখনই একটা সিএনজি আসতে দেখছি, তখনই এক সাথে দশ–বারোজন মরিয়া হাত নেড়ে থামতে বলছি। কাছে আসতেই দেখা যাচ্ছে ভেতরে যাত্রী। শাঁ করে করে একটার পর একটা বেরিয়ে যাচ্ছে। আধঘণ্টা পর একটা ‘খালি’ পাওয়া গেল।

—চিড়িয়াখানা যাবেন?
—যাব
একসময় ঢাকা শহরে মিটারে সিএনজি চলত বলে কোনো কোনো ঐতিহাসিক গবেষণায় অথেনটিক তথ্য পাওয়া যাবে। তবে আজকালকার দিনে মিটারটা সুন্দর করে চালানো থাকলেও কোনো চালকই যে মিটারে যান না, সেটা আমরা জানি। এই কারণে সরল সোজা কায়দায় বললাম
—কত?
—ছয় শ টাকা।

মুগদা থেকে চিড়িয়াখানায় মিটারে গেলে ভাড়া উঠবে সর্বোচ্চ ২২০ টাকা। মিটার ছাড়া ‘কন্ট্রাক্টে’ গেলে বড়জোর তিন শ। কিন্তু এই ভাইটি চাইলেন ছয় শ টাকা! ভাড়া শুনে আমার চোখে বিস্ময় ভর করলেও তিনি অত্যন্ত নিরুত্তেজিত ও উৎকণ্ঠামুক্ত চোখে আমার দিকে চাইলেন। তাঁর অভিব্যক্তি দেখে বোঝা যাচ্ছিল, তিনি ভাড়া কমাবেন না। কারণ, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আরও চার-পাঁচজন যাত্রী এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছেন। আমার কথা শেষ হলেই তাঁরা কথা বলবেন। বাচ্চারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিল। ভাগ্যিস, পকেটে টাকা ছিল। সে কারণে রিস্ক নিলাম না। ছয় শ টাকাতেই রাজি হয়ে উঠলাম। সিএনজি চলতে লাগল।

—ভাই, এইটা কি ইনসাফ হইলো? আড়াই শ টাকার ভাড়া তিন শ নিতেন, না হয় চার শই নিতেন। তাই বলে ছয় শ!

সিএনজিচালক সামনের দিকে চেয়ে চালাতে চালাতে বললেন,
—ইনসাফ কি আছে এই দুইন্ন্যায়? এই যে গরমেন্ট ফট কইর‍্যা ৬৫ ট্যাকার ত্যাল ৮০ টাকায় নিয়া ঠ্যাকাইলো, এইডা ইনসাফ? কথা নাই বার্তা নাই, বাসমালিকরা বাস বন্ধ কইর‍্যা দিলো, এইডা ইনসাফ? আমার গাড়ি চলে সিএনজিতে, ডিজেলে না, তারপরও মালিকও জমার টাকা তিন শ বাড়ায়ে দিছে, এইডা ইনসাফ?

পাবলিক জানে, উন্নয়ন ও দুর্নীতি এই দেশে মাসতুতো ভাই। মানুষ বাঁচুক আর মরুক এই দুই ভাইকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। ভদ্রলোক সারা পথ গজর গজর করতে করতে গেলেন।
চিড়িয়াখানা ঘুরে বাসায় আসতে আবার সিএনজি ভাড়া লাগল পাঁচ শ টাকা। টেনেটুনে মধ্যবিত্ত লেবেল গায়ে সাঁটা একটি পরিবারের মুগদা থেকে মিরপুরে যাওয়া–আসায় মোট লাগল এগারো শ টাকা।

শনিবার অফিসে আসতে আবার রাস্তায় নেমেছি। অবস্থা আগের দিনের চেয়ে খারাপ। শিশু, বৃদ্ধ, রোগীসহ অসংখ্য নারী-পুরুষ গাট্টি–বোঁচকা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন। গাড়ি ঘোড়া নাই। রিকশার ভাড়া তিন গুণ হয়ে গেছে। অনেকের পকেটে সেই ভাড়া নেই। প্রথম আলোর খবরে দেখা যাচ্ছে, গাবতলীতে পরিবহনের জন্য বসে ছিলেন চাকরিপ্রার্থী আমেনা বেগম। কোলে সাত মাসের সন্তান। যাবেন ফরিদপুরে। শুক্রবার চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। ফেরার জন্য গাড়ি না পেয়ে একপর্যায়ে কাঁদতে শুরু করেন তিনি।

তাঁর মতো হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে। কেউ কেউ রাস্তাতেই বসে পড়েছেন। তাঁদের চেহারা দেখে মনে হলো, তাঁদের কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। যেন তাঁরা গার্জিয়ান ছাড়া নৈরাজ্যকর এক ‘নেই রাজ্যের’ বাসিন্দা। এটাই কপালে লেখা ছিল, তাই সবাই মেনে নিয়েছে।

তেলের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ভাড়া বাড়ানোর নাটক দু–চার দিনে শেষ হবে। বাড়তি ভাড়া দেওয়াও জনতার সয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু এই জ্বালানি তেল কাঁচাবাজারে যে আগুন ইতিমধ্যেই লাগিয়ে দিয়েছে, তা নিভবে কী করে?

মাসখানেক আগে থেকেই চালের আর সয়াবিনের দাম বাড়ার কথা মুখে আনা আর চুন খেয়ে মুখ পোড়ানো সমান কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘নাবালেগ’ অবস্থায় খেত থেকে তুলে বাজারে আনা পানসে মরিচেরও দস্তুরমতো ‘ঝাল’ বেড়েছে। পেঁয়াজের ঝাঁজো নাক জ্বালা করে। ঝিঙে, উচ্ছে, বেগুন, টমেটো ছুঁলেই হাত পুড়ছে। ছেঁকা দিচ্ছে আলুও। লাউ বা ফুলকপি ঝলসে দিচ্ছে হাত। এই হাঁসফাঁস দশার মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল। এই শাকসবজি আসে ট্রাকে। ডিজেলের দাম বাড়ায় ট্রাকভাড়া যেভাবে বাড়বে এবং পটোলের দাম যেখানে গিয়ে ঠেকবে, তাতে পটোল খাওয়ার বদলে তুলতে হবে।

তেলের দাম কেন বাড়ে, তার অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া কী, দাম বাড়ার পেছনে আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব কতখানি—এই সব ভারী ভারী প্রশ্ন নিয়ে ইতিমধ্যেই বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। আপাতত যে প্রশ্নটি তোলা সবচেয়ে জরুরি, সেটি হলো, তেলের দাম বাড়লে আমাদের মতো এনজিওপুষ্ট সুশীল মধ্যবিত্ত ও হাভাতে গরিবদের জীবনে যে প্রভাব পড়ে, তা কি দাম বাড়ানো ভদ্রলোকেরা জানেন?

বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম পড়ে গিয়েছিল, তখন আমাদের দেশে দাম কমানো হয়নি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) আগে যত লোকসান গুনেছে, তা তুলতে হবে।

সেই লোকসান তোলার পর তখন বিপিসি লাভ করেছিল ৪০ হাজার কোটি টাকা। তখন মানুষ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার কোনো উপকার পায়নি। আর এখন সেই আন্তর্জাতিক বাজারের কথা বলে তারা দাম বাড়িয়ে দিল। মানে তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে যে বানর বাঁশের আগায় উঠে বসেছে, বিপিসি জনগণের তেল বের করে হলেও সেই বানরকে আর নামতে দেবে না।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ায় বিপিসির লোকসান হচ্ছে। বিপিসি প্রায় ৩৩ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছে। লোকসান হতে থাকলে এই প্রকল্পগুলো চালানো কঠিন হবে। পাবলিক জানে, উন্নয়ন ও দুর্নীতি এই দেশে মাসতুতো ভাই। মানুষ বাঁচুক আর মরুক এই দুই ভাইকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।

গণপরিবহনমালিকেরা সরকারি নীতিনির্ধারকদের অফিস ঘরকে জাতীয় মামাবাড়ি মনে করে সেখানে ঝুড়িভরা আবদার ফেলছেন। তাঁদের আবদার আগেও বিফলে যায়নি, এবারও যাবে বলে মনে না।

আমরা তেলের দাম বাড়ায় যাতে বেশি টেনশন না করি, সে জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে গেলেই সরকার আবার তেলের দাম কমানোর উদ্যোগ নেবে। অর্থাৎ যে কাজ তারা অতীতে করতে পারত কিন্তু করেনি, সেই কাজ তারা ভবিষ্যতে করবে—এই কথা জনগণকে বিশ্বাস করতে বলেছে।

পরিবহন ও উৎপাদনের সঙ্গে তেলের দাম বাড়া–কমার সরাসরি যোগসূত্র থাকলেও অন্য জিনিসের দাম বাড়ানোর সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। তিনি বলেছেন, ডিজেলের দাম বাড়ার অজুহাতে অন্য পণ্যের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। ওদিকে গণপরিবহনমালিকেরা সরকারি নীতিনির্ধারকদের অফিস ঘরকে জাতীয় মামাবাড়ি মনে করে সেখানে ঝুড়িভরা আবদার ফেলছেন। তাঁদের আবদার আগেও বিফলে যায়নি, এবারও যাবে বলে মনে না।

লাগামছাড়া দাম বাড়াকে একধরনের পরোক্ষ কর বলা যেতে পারে। এই কর ‘রিগ্রেসিভ’ চরিত্রের। মানে যাঁর আয় যত কম, তাঁর ওপর করের বোঝা তত বেশি পড়ে। গত মাসে যে জিনিসের দাম এক শ টাকা ছিল, এই মাসে তা যদি এক শ তিরিশ টাকা হয়, তাহলে যিনিই সেই জিনিস কিনবেন, তাঁর কাছ থেকেই সেই বাড়তি তিরিশ টাকার ‘কর’ আদায় করা হবে। যাঁর মাসিক আয় যত কম, এই বাড়তি কর তাঁর আয়ের শতাংশ হিসাবে তত বেশি।

মহামারি পরিস্থিতিতে যখন দেশে আর্থিক বৈষম্য ভয়ানক রকমের ঊর্ধ্বমুখী, পিপিআরসি ও বিআইজিডির জরিপে যখন নতুন দরিদ্রের খাতায় আরও ৩ কোটি ২৪ লাখ মানুষকে যুক্ত হতে দেখা গেছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁদের ওপর এই বাড়তি ‘করের’ বোঝা চাপানোর ঘটনা জনগণকে শোষণের শামিল।

যেহেতু সবার ওপরে রাজনীতি সত্য, যেহেতু তেলের মূল্যবৃদ্ধিলব্ধ টাকাগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের হাত ঘুরে সংখ্যায় নগণ্য অথচ অতি শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির পকেটে পৌঁছাবে, সেহেতু অর্থনীতি এখানে ব্যাকরণমাফিক চলবে না। সাধারণ মানুষের পাশে থাকার কথা মেঠো বক্তৃতায় যত জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হয়, কার্যক্ষেত্রে ছবিটি যে চিরকালই বিপ্রতীপ, তা অর্থনীতির কঠিন আলোচনা না বোঝা পাবলিকও ভালো করে জানে।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]