পূজারও ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে

পূজার মেলার পুতুলের শোভা
পূজার মেলার পুতুলের শোভা

‘তুমি যেন ভুল বুঝো না...’ মাইকে গান বাজছে। তার মানে পূজা শুরু হয়ে গেছে। দূরে থেকে মণ্ডপের মাইকে সেই চেনা সুর, ‘আমি তার ছলনায় ভুলব না...’—এবার সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একে একে মান্না দে, বাপ্পি লাহিড়ী, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখার্জি, আশা-লতাসহ কত কত শিল্পী; সঙ্গে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের কিছু গান।

আশির দশকে রংপুরের পূজার সকালগুলো কেমন যেন অপরিচিত সৌন্দর্যে আবেগময় ছিল। মনের মধ্যে এক অচেনা আনন্দ বোধ হতো। সবচেয়ে কাছের মণ্ডপ ছিল গুপ্তপাড়ার মোড়ে, মূলত সেখান থেকে ভেসে আসা গানেই পূজার আহ্বান জানাত। ইচ্ছে দেবী মুখদর্শন। আমার কাছে দুর্গা এক অসম্ভব কাল্পনিক নারীমূর্তি ছিল। অবাক হয়ে দেখতাম দশটা হাত, কী করে ব্লাউজ পরে এতগুলো হাত নিয়ে। আম্মার ব্লাউজ নিয়ে নাড়াচাড়া করি। কোন কোন দিক দিয়ে আরও আটটা হাত হতো, যদি এটা দুর্গার ব্লাউজ হতো!

আহা, পরনে জীবন্ত শাড়ি—লাল কাতান। অবাক হতাম। তবে যে দেবীর শাড়ি মাটির হতো, বেশি ভালো লাগত না। মুখশ্রী সুন্দর হলে মন বসত কখনো। এত দিঘল কালো লম্বা চুল কী যে সুন্দর! অলংকৃত সাজসজ্জা। সবই জীবন্ত হয়ে ফুটে আছে অলৌকিক মনুষ্যরূপ। ইলুশন! তা-ই হতো আসলে। হাতের অস্ত্রগুলোর নাম জানতাম না। কেউ কেউ পাশ থেকে বলত, সেখান থেকে শুনে কিছু শেখা ছিল। যেমন: ত্রিশূল, পদ্ম, শঙ্খ, তির আরও কী কী। কথা যা সত্য, মণ্ডপে দাঁড়ানোর ভঙ্গি এমন ছিল যেন কেউ বুঝতে না পারে আমি হিন্দু নই। মুসলমান বলে যদি কেউ বের করে দেয়। ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম শেষে যদি এই মহান শিল্পদর্শন থেকে বহিষ্কৃত হই।

আমাদের বাসার খুব কাছাকাছি তিন-চারটা মণ্ডপ ছিল। এর মধ্যে বিশাল আয়োজন হতো বড় গুপ্তপাড়ায়। সালেমা স্কুলের পাশে। কেন যেন তখন গুপ্তপাড়াকে দুই ভাগে ডাকা হতো, জানা নেই। কাছের মণ্ডপগুলো নিজে নিজে ঘুরে দেখতাম ছোটবেলায়। একটু দূরের মণ্ডপগুলো নিয়ে যাওয়ার বায়না মামাদেরই মিটাতে হতো। আম্মার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় মামাদের আশ্রয়ে ঘুরতে যাওয়া।

ঘুরে ঘুরে পূজা দেখার প্রথম মজা কোন দেবী কত সুন্দরী। কার শাড়িটি বাস্তব? চোখ ঘুরছে সবার ওপর...মাথায় আসে না কলাগাছও বউ। গণেশ আমার প্রিয়। দেখলেই আদর লাগে, ভুঁড়িতে মাথা দিয়ে হেলান দিতে মন চায়। এখন বুঝি এত সুন্দর সৃজনশীল সৃষ্টি দুটো নেই। মানুষ আর হাতির সমন্বয়ে এই রূপ সৃষ্টি চাট্টিখানি বিষয় নয়রে পাগলা!

সুনয়না দেবীদের চোখের দিকে তাকালে আমি কোথায় যেন হারাতাম? তিনটা চোখ আমাকে ভাবাত বটে, তারপর কিছুক্ষণ সুন্দর দুচোখই মন কাড়ে। এত বড় চোখ, চোখের পাতা। মায়াভরা চাহনিতে আমি নিজেই চোখ বড় করে হারিয়ে যাই। বিস্ময় চোখে দেবী দেখতে দেখতে বুঝি, আমার নিজের চোখই বড় হয়ে গেছে। খাতার পাতায় পাতায় দেবীর চোখ এঁকে ভরে দিতাম।

প্রতিবার পূজা এলে আমার মনের মধ্যে একটি জিনিসের চাহিদা ব্যাকুল করত। সেটা পূজার মণ্ডপ ছাড়া কখনোই পাওয়া যেত না। মণ্ডপের মেলা বা ছোট ছোট দোকানপাট আমাকে মরিয়া করে তুলত। দিনের মধ্যে কতবার যে দৌড়ে দৌড়ে সেখানে যেতাম। কটা টাকা পেলেই হলো। আচার কিনতাম প্যাকেটের; ছোট একটা পিতলের আংটি দিত বলে। একবার একটা ভাঁজ করা গোলাপি কাগজের কলস ফুল জিতেছিলাম, মাটিতে লটারি খেলে। প্রতিটি খোপে রাখা থাকত আকর্ষণীয় পণ্যাদি। তিব্বত স্নো, সাবান, বাঁশি, পিস্তল, চকলেট, কত-কী! আসলে ওটা ছিল শিশুজুয়া। হা হা হা! পূজার কত আনন্দ!

ওই কয়েক দিন বাড়িতে মামা, চাচা, খালা, খালু কেউ এলেই কীভাবে টাকা আদায় করা যায়, এ ছাড়া মাথায় কিছুই থাকত না। মনে মনে মেলায় কোথায় কী দেখেছি তার হিসাব চলত। একগাদা ছোট ছোট মাটির হাঁড়ি-পাতিল কেনার বাসনা থাকে, কিনে ফেলিও চুপিসারে। এমন অনেক শখের জিনিস।

কিন্তু সেই জিনিসটি? যার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠি, সেটা কিনব না! কখনো কখনো সেটা কাছের মণ্ডপে না পাওয়া গেলে ছুটে যেতাম আদর্শপাড়ার আদর্শ স্কুল মাঠের মণ্ডপে। একবার চুরি করে আমি একাই গিয়েছিলাম ওখানে, ওটা আমার সীমানার বাইরে, যা আবার আম্মার হাতের থাপ্পড়ের সীমানায় পড়ে। দুই গুপ্তপাড়া খুঁজেও যখন সেই জিনিসটা পেলাম না, তখন হেঁটেই চলে যাই আদর্শপাড়া। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই মাটিতে দৌড়ানো ইঁদুরছানা। মানে খেলনা। হ্যাঁ, প্লাস্টিকের এই ইঁদুরটার পেছনে একটা রাবারের লেজমতো ছিল, যা টান দিয়ে ছেড়ে দিলে সামনে দৌড়াত। কালো ও খয়েরি দুই রঙের হতো। একটি লেজও ছিল। ছোট একটা রিংমতো ছিল রাবারের মাথায়। ওটা ধরেই দে টান, তো ছুটছে।

জানা নেই, কেন এই খেলনাটার প্রতি আমার ছিল দুর্বোধ্য আকর্ষণ? ওই বেলার ওই জিনিসটা আর এই বেলার আমিতে কোনো মিল নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের প্রাণী বলতেই আমার কাছে ইঁদুর। কেন মানুষের এমন পরিবর্তন হয়? একটা ইঁদুর দেখামাত্র এক লাফে সর্বোচ্চ যত ঊর্ধ্বে ওঠা সম্ভব আমি শিখে গেছি, সঙ্গে চিৎকার। সেই পূজামণ্ডপ থেকেই ইঁদুরটি আমাকে তাড়া করল। রোজ খুঁজি ঘরের ইঁদুর, প্রাত্যহিক জীবন যেন বিনষ্ট না হয়। আর এখন পূজা এলে খুঁজি প্লাস্টিক ইঁদুর-স্মৃতি, যা থেকে স্মৃতির কষ্ট মেলে শুধু, হারিয়ে যাওয়া আমার রংপুর, আমার পূজা, আমার শৈশব।

আহা, পূজা মানেই মাইকে ভেসে আসা সেই সব গান আর আমার একমাত্র খেলনা প্লাস্টিকের ইঁদুর।

কবে যে কোন ইঁদুরে কেটেছে দেশ?

মুসলিম হিন্দুদের মারবে না, হিন্দু মুসলিমকে, বৌদ্ধ মুসলিমকে, মুসলিম বৌদ্ধকে কিংবা খ্রিষ্টান দাপট চলবে না বিশ্বময়। নির্লজ্জ রাজনীতিতে মানুষ লোভী, পাপী।

কেন ধর্ম শিল্প নয়?

লেখক: প্রবাসী চলচ্চিত্রকার।