পোলিও নির্মূলে সাফল্য

এ বছরের ২৭ মার্চ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য হয়ে উঠতে পারে এক অবিস্মরণীয় দিন। সত্তরের দশকের শেষ থেকে পোলিও নির্মূলের যে লড়াই চলছে, তাতে অবশেষে জয়ী হতে চলেছে এই অঞ্চল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২৭ মার্চ এই অঞ্চলকে পোলিওমুক্ত বলে ঘোষণা করার সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গোটা বিশ্বকে বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করেছে। এককভাবে কোনো দেশকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করা যায় না। কারণ, ভাইরাসের যাতায়াত সর্বত্র। সে রাষ্ট্রীয় বা ভৌগোলিক সীমানা মানে না। সে কারণেই এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা। লক্ষ্যমাত্রার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছেও একবার হেরে যেতে হয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে। প্রায় তিন বছর পোলিওমুক্ত থাকার পর ২০১১ সালের ১৩ জানুয়ারি ভারতে এক রোগীর শরীরে পোলিও ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী টানা তিন বছর একটি অঞ্চলে যদি একজন রোগীর শরীরে সংক্রমণ দেখা না দেয়, শুধু তাহলেই অঞ্চলটি পোলিওমুক্ত বলে স্বীকৃতি পেতে পারে।
২০১১ সাল থেকে টানা তিন বছর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি সদস্যদেশকে কঠোরভাবে নজরদারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সদস্যদেশগুলো প্রতিটি প্রতিবেদন নিরপেক্ষ পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করেছে। তারপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে নিরপেক্ষ বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞরা আবার প্রতিটি দেশের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করেন। তার পরই আসে সিদ্ধান্ত, যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের রিজিওনাল সার্টিফিকেশন কমিশন ভারতের নয়াদিল্লিতে তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে যাচ্ছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আগে আমেরিকা (১৯৯৪), পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল (২০০০) ও ইউরোপ (২০০২) অঞ্চলকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পোলিওমুক্ত বলে ঘোষণা করে।
এই শুভ মুহূর্তে লাখ লাখ স্বাস্থ্যকর্মীর কথা বারবার মনে পড়ছে। কোনো প্রতিকূলতাই তাঁদের কাছে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাঁরা পৌঁছেছেন সব শিশুর কাছে। বহু শিশু আছে, যাদের বসবাস দুর্গম এলাকায়, যারা বস্তিতে থাকে, যারা পথশিশু, যারা যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা ঝড়-ঝঞ্ঝা-বন্যা-ভূমিকম্পের কারণে ভিটেমাটি ছাড়া। এদের সবার কাছে পৌঁছেছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। পোলিও নির্মূলে আসলে এই অঞ্চলের সরকারগুলো এবং
সব শ্রেণী-পেশার মানুষ আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন। পোলিও নির্মূলে সামাজিক অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। টিকা দেওয়ার সুফল সম্পর্কে প্রচার করেছেন স্থানীয়, প্রথাগত ও ধর্মীয় নেতারা। সাধারণ মানুষের মনে টিকা সম্পর্কে যে ভুল ধারণা কাজ করে, তাঁরা
তার অবসান ঘটিয়েছেন। তাঁদের সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
আরও উল্লেখ্য, অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, জাতীয়, স্থানীয়, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কীভাবে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে, তারই একটি মডেল এ কর্মসূচি। গ্লোবাল পোলিও ইরাডিকেশন ইনিশিয়েটিভ এবং প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রোটারি ইন্টারন্যাশনাল, ইউনিসেফ এবং ইউনাইটেড স্টেটস সেন্টারস ফর ডিজিজেজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন এখন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনসহ অনেক সহযোগী সংস্থার সহযোগিতা পায়।
পোলিও নির্মূলের সরাসরি সুফল হচ্ছে বহু শিশুর প্রাণ রক্ষা এবং সারা জীবনের পঙ্গুত্ব প্রতিরোধ। এই সাফল্য প্রমাণ করে, হাম ও রুবেলার মতো রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও একই রকম সাফল্য লাভ করা সম্ভব। আরও যে কথাটি মনে করিয়ে দিতে চাই তা হলো, পোলিও প্রতিরোধের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। বহু পরিবার সুস্থ ও উৎপাদনমুখী জীবন পেয়েছে।
এক দিক থেকে পোলিও নির্মূল কর্মসূচি পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জোরদার করেছে। স্বাস্থ্যকর্মী ও সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। শিশুরা যেসব রোগে ভোগে, সেগুলো প্রতিরোধে টিকা ও স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থার উন্নয়নে যন্ত্রপাতি দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় পোলিও নির্মূল হচ্ছে সবার শেষে। তবে, আমাদের লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী। টিকার মাধ্যমে যে রোগগুলো প্রতিরোধ করা যায়, তার তুলনায় ম্যালেরিয়া, এইচআইভি/এইডস ও যক্ষ্মা রোধ অনেক সহজ। আমরা এখনো বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে টিকা দেওয়া কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু অপেক্ষাকৃত সাধারণ রোগগুলো প্রতিরোধে আরও অনেক কিছু করতে হবে। পোলিও নির্মূল কর্মসূচি যেভাবে এগিয়েছে, একই কাঠামো অনুসরণ করে এই রোগগুলোও প্রতিরোধ করতে হবে।
আমরা ইতিমধ্যে বেশ কিছু সুফল পেয়েছি। দারুণ একটা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এতে অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হয়েছে। যেমনটা আমরা দেখেছি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে। যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মাঠকর্মী ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যাপকভিত্তিক নেটওয়ার্ক এখন সফলভাবে কাজ করছে।
কোথায় গেলে নিরাপদ প্রসব সম্ভব, কোথায় যক্ষ্মার চিকিৎসা পাওয়া যায় এবং কীভাবে এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়, সেসব তথ্য নিয়ে যাওয়ার সুযোগ আমাদের রয়েছে।
কারণ, পোলিও নির্মূল কর্মসূচির বদৌলতে আমরা এখন জানি, সেসব শিশু কোথায় থাকে, যাদের কাছে পৌঁছানো ছিল খুবই কঠিন। অন্য কোনো স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আবার তাদের কাছে না যাওয়ার কোনো অজুহাত দেখানোর আর সুযোগ রইল না। তবে তাদের পরিবার এবং পুরো কমিউনিটির কাছে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য-তথ্য নিয়ে যাওয়া এখন আর কোনো কঠিন কাজ নয়।

ড. পুনম ক্ষেত্রপাল সিং: আঞ্চলিক পরিচালক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।