পোশাক শিল্প সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তনের সময় এসেছে

ইথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদনব্যবস্থায় নৈতিকতার তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়

সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত, যেটাই বলেন না কেন, করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা বা সিএসআরের প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সব সময় বিশ্বের নজর বা আলোচনার প্রধান উপলক্ষই হয়ে ওঠে। অর্থাৎ যখনই করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার বা সোশ্যাল কমপ্লায়েন্সের প্রসঙ্গ আসবে, তখনই সবার নজর থাকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ওপর। শিল্পে দুর্বল ও অনিরাপদ কর্মপরিবেশের একটি অতি প্রচলিত উদাহরণ হিসেবে প্রায়শই বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা হয়। কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে যদি বিশ্বের কোনো সংবাদমাধ্যম কোনো প্রতিবেদন তৈরি করতে চায়, তাহলে তারা প্রায়শই বাংলাদেশকে বেছে নেয়।

গত মাসে রানা প্লাজার ৮ম বার্ষিকীর প্রাক্কালে বাংলাদেশ আবার বিশ্ব গণমাধ্যমগুলোর আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক মহলের বহু মন্তব্যকারী তাঁদের তির্যক সমালোচনার তির বাংলাদেশের দিকে ছুড়েছেন। তাঁদের বক্তব্য বা মতামত যদি কেউ সবটা পড়েন, তাহলে তিনি মনে হয় বাংলাদেশ থেকে আর কোনো পোশাক ক্রয় করতে উৎসাহিত হবেন না।

যাঁরা আমাদের পোশাকশিল্পকে নিয়ে এত সমালোচনায় মেতে ওঠেন, তাঁদের কয়জনের বাংলাদেশ ও এ দেশের পোশাকশিল্প সম্পর্কে বাস্তব ও সরাসরি অভিজ্ঞতা রয়েছে? আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বেশির ভাগ সমালোচনাকারীই বাংলাদেশের মাটিতে কোনো দিন পা রাখেননি। তাহলে তাঁদের মন্তব্য কতটা বাস্তবসম্মত ও বিশ্বাসযোগ্য? বাংলাদেশ এবং এর পোশাক কারখানার যে চিত্র তাঁদের লেখায় বর্ণিত বা চিত্রায়িত হয়, তা বাস্তবিক পক্ষে আমার কাছে পুরোটাই অপরিচিত লাগে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনা কখনো ভোলার নয়। এমন নির্মম দুর্ঘটনায় প্রাণহানিতে বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবী ব্যথিত ও শোকাহত হয়েছিল। কিন্তু আমাদের খেয়াল করা জরুরি যে এই দুর্ঘটনার পর বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হয়েছে। যে সময়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাসমূহে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাবধানে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। কারখানাগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তাদের কারখানায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। কিউআইএমএ কর্তৃক পরিচালিত জরিপে ‘ইথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং’ বা উৎপাদনব্যবস্থায় নৈতিকতার প্রতিফলন রয়েছে, এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে, যেখানে বাংলাদেশের স্কোর ৭ দশমিক ৭। তাইওয়ান ৮ পয়েন্ট পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। ভিয়েতনামের অবস্থান তৃতীয়। তার পরই যথাক্রমে রয়েছে থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, তুরস্ক, চীন, ভারত ও ব্রাজিল।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতায় বাংলাদেশ পোশাকশিল্পে শিশুশ্রম নির্মূল করেছে বহু আগেই। শ্রমিকের মজুরি কয়েক দফায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। যদিও আমাদের এসব সাফল্য ধরে রাখতে সব সময় সচেষ্ট থাকতে হবে। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। ১৩৯টি লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ স্থান দখল করেছে। এই ১৩৯টি লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার মধ্যে ৩৯টি প্লাটিনাম এবং ৮৪টি কারখানা গোল্ড মানের।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এত ইতিবাচক অর্জনের পরও আমরা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে যে শিল্পের চিত্র দেখতে পাই, সেখানে এই সব আধুনিক কারখানার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই না। আমাদের শিল্পের জনসংযোগের জায়গাটাতে আমাদের উন্নতি করতে হবে। সেটি নিয়ে হয়তো পরে কখনো আলাদা করে আলোচনা করা যাবে।

কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার। রানা প্লাজার পূর্বেকার অবস্থান থেকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প এখন অনেক ভিন্ন। রানা প্লাজা-পরবর্তী সময়টাতে পোশাকশিল্পের পরিস্থিতির ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। পরিবর্তনের ব্যাপ্তি যতটা দেখা যায়, তার চেয়ে আরও বেশি প্রসারিত। আমি প্রায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে পোশাক কারখানা পরিচালনা করে আসছি। কাজেই এ শিল্পের মধ্যে সাধিত পরিবর্তনগুলো আমি প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করেছি। এ শিল্পে বিগত সময়টাতে কী পরিমাণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা হয়তো ভাষায় বোঝানো কষ্টসাধ্য হবে। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের বর্তমান অবস্থা আগের অবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সদা পরিবর্তনশীল বিশ্ব পোশাকশিল্পের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার তাগিদে আমাদের শিল্পের পরিবর্তিত না হয়ে থাকার কোনো উপায়ও ছিল না।

সমালোচনার আরেকটি ক্ষেত্র হলো পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা। শ্রমিক অসন্তোষ কি বাংলাদেশে একটি ইস্যু? সময়ে সময়ে এটি অবশ্যই একটি আলোচিত ইস্যু, যেমনটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও হয়ে থাকে। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা ঘটে থাকে। তারপরও এনজিওগুলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দিকে যদি আপনি লক্ষ করেন, তাহলে আপনার মনে হবে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ যেন নিত্যদিন লেগেই থাকে। অথচ তা সত্য নয়।

যাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে লিখে থাকেন, তাঁদের সমালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং আমার বিশ্বাস, অনেকেই এ শিল্পের কল্যাণ সাধনের বোধ থেকেই লিখে থাকেন। এই কথা অনস্বীকার্য যে শিল্পকে গঠনমূলক সমালোচনা গ্রহণ করতে হবে এবং যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তা থেকে আরও ভালো ও উন্নতি করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। একই সঙ্গে পোশাকশিল্প বিগত বছরগুলোতে যে সাফল্য অর্জন করেছে, সেসব পরিবর্তন ও সাফল্যকে স্বীকৃতি দেওয়াটাও জরুরি। কারণ, উদ্যোক্তা, ক্রেতা ও সরকারের সম্মিলিত প্রয়াসে পোশাকশিল্পে যে ইতিবাচক পরিবর্তন ও সাফল্য অর্জিত হয়েছে, শিল্প সম্পর্কে যেকোনো বিভ্রান্তিকর তথ্য বা চিত্র তাকে ম্লান করে দেবে।

নতুন কোনো ক্রেতা যখন প্রথমবার বাংলাদেশে আসেন এবং পোশাক ক্রয়াদেশ দেওয়া উপলক্ষে পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেন, তখন কিছুটা অবাক হয়ে যান। কেননা, তাঁরা বাংলাদেশের পোশাকশিল্প সম্পর্কে এত দিন ইন্টারনেটে যা পড়েছেন বা দেখে এসেছেন, বাস্তবে তার চেয়ে পুরোপুরি ভিন্ন একটি চিত্র দেখতে পান। সংবাদ প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে যা পড়েছেন বা জেনেছেন, বাস্তব চিত্র তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, অর্থাৎ অনেকটাই ভিন্ন। কাজেই আমি সব বিদেশি বন্ধুকে বাংলাদেশে এসে নিজ চোখে এ দেশের পোশাকশিল্পকে প্রত্যক্ষ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। আমরা যেকোনো গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগতম জানাই। তবে এমন কোনো মন্তব্য করা, বাস্তবতার সঙ্গে যার কোনো সাদৃশ্য নেই বা এমন কোনো সংবাদ পরিবেশন করা, যা সত্য ও বাস্তবতা বিবর্জিত; তা বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অর্জনকে ম্লান করার অপপ্রয়াসের শামিল। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের অবাস্তব ও অসত্য মন্তব্য বা সংবাদ পোশাকশিল্পের নিরাপদ ও সাসটেইনেবিলিটির অভিমুখে অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে।

মোস্তাফিজ উদ্দিন ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান নির্বাহী