প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ জি–৭ শীর্ষ বৈঠক

বৈঠকে জি–৭ জোটভুক্ত দেশগুলোর নেতারা।
ফাইল ছবি: এএফপি

শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি–৭–এর শীর্ষ বৈঠকে বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করতে সম্মত হওয়াকেই দেশগুলোর নেতারা বড় প্রাপ্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। চলমান মহামারি মোকাবিলা, জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট সমাধান এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রসার ও সুরক্ষার বিষয়গুলোতে সম্মেলনের চূড়ান্ত ঘোষণায় যেসব অঙ্গীকার ও পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়েছে, তা এরই মধ্যে তীক্ষ্ণ সমালোচনার মুখে পড়েছে।

শীর্ষ বৈঠকের পর আলাদা সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, স্বাগতিক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ও ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ দীর্ঘ বিরতির পর সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারার বিষয়টিকেই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, ‘আমেরিকা আলোচনার টেবিলে ফিরেছে’ এবং ‘বিশ্বের গণতন্ত্রগুলোকে শক্তিশালী করাই হচ্ছে জি–৭–এর কাজ।’

করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোতে আগামী এক বছরে জোটগতভাবে ১০০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহের সিদ্ধান্তকে ইতিমধ্যে জি–৭–এর নৈতিক ব্যর্থতা বলে অভিহিত করে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বলেছেন, এর ফলে হাজার হাজার মৃত্যু ঘটবে, যা এড়ানো সম্ভব ছিল। দরিদ্রদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা অক্সফাম বলেছে, জি-৭ বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ পূরণে ব্যর্থ হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, ১ হাজার ১০০ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন। কিন্তু ১০০ কোটি ডোজ সে তুলনায় নগণ্য। এসব সমালোচনার জবাবে বরিস জনসন জোটের ভূমিকাকে ‘বিপুল অবদান’ বলে অভিহিত করলেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আরও ১০০ কোটি ডোজ দিতে পারবে, যার ঘোষণা এখনই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর ঘোষিত ৫০ কোটি ডোজ টিকা জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনাধীন কোভ্যাক্সের বাইরে এবং জি–৭–এর অন্যরা দেবে বাকি ৫০ কোটি ডোজ।

করোনার টিকার ক্ষেত্রে পেটেন্ট অব্যাহতির প্রশ্নে জি–৭–এর ঘোষণায় ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত না আসাও অনেক উন্নয়নশীল দেশ এবং নাগরিক অধিকার গোষ্ঠীগুলোর জন্য একটি হতাশার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্র এতে রাজি থাকলেও যুক্তরাজ্য সম্মত হয়নি। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জনসন বলেন, গবেষণা ও উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার জন্যই পেটেন্ট অব্যাহতি ঠিক নয় এবং আফ্রিকাসহ অন্যান্য জায়গায় উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানোর সম্ভাবনাগুলো বিশেষভাবে যাচাই করা হচ্ছে। বেসরকারি খাতকেও সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ অব্যাহত আছে জানিয়ে তিনি বলেন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদন খরচ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং এই টিকায় কোনো মুনাফা নয়। পেটেন্ট অব্যাহতি দাবির পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যাদের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে, তাদের কাজে লাগানো হলে উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব এবং তার পরিবহন ও সরবরাহব্যবস্থাও অনেক সহজ হতো।

জি–৭–এর ঘোষণায় আছে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের অঙ্গীকারও। তবে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা এবং ডিজেল ও পেট্রলচালিত গাড়ির প্রচলন বন্ধের সময়সূচি নির্ধারণে সমঝোতা না হওয়া এবং দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তার জন্য জলবায়ু তহবিলের অর্থায়নে ঘাটতির কারণে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং প্রধানমন্ত্রী জনসন দুজনেই বলেছেন, কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে ভর্তুকি দেওয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জি–৭ শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণায় এই প্রথমবারের মতো সরাসরি চীনের কথা এসেছে। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’–এর বিকল্প হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়নে সহায়তার জন্য ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড (বিথ্রিডব্লিউ)’ উদ্যোগের কথা রয়েছে এ ঘোষণায়। পরে সংবাদ সম্মেলনেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, এখন ‘স্বৈরাচারদের প্রতিযোগিতা’ শুরু হয়েছে এবং গণতন্ত্রগুলোর জন্য তাই এখন দায়িত্ব হচ্ছে এটা দেখানো যে তারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম। চীনের প্রশ্নে জি–৭ একমত হওয়ায় তিনি সন্তুষ্ট। জোটের ঘোষণায় দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ান প্রণালির পরিস্থিতির উল্লেখ করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক আইনভিত্তিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।

তবে জি–৭–এর ঘোষণায় বেল্ট অ্যান্ড রোডের পাল্টা উদ্যোগ ঘোষণাসহ চীনের যেসব সমালোচনা করা হয়েছে, তার তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছেন লন্ডনে চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র। রয়টার্স জানিয়েছে, কয়েকটি দেশের একটি ছোট গোষ্ঠী বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবে—এমন দিন গত হয়েছে। মুখপাত্রের কথায়, ‘আমরা সব সময় বিশ্বাস করি যে ছোট কিংবা বড়, দুর্বল কিংবা সবল, দরিদ্র অথবা ধনী সবাই সমান এবং বিশ্বের যেকোনো বিষয় সবার আলোচনার ভিত্তিতেই হওয়া উচিত।’

বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান এবং সেখানকার বাস্তুচ্যুতদের বিষয়ও জোটের ঘোষণায় রয়েছে। সামরিক শাসনের নিন্দা করে আসিয়ান জোটের গৃহীত পাঁচ দফা পদক্ষেপ দ্রুত বাস্তবায়নের বিষয়ে শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়। রোহিঙ্গাদের নাম উল্লেখ না করা হলেও মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুতদের মানবিক সহায়তায় তহবিল জোগানোর জন্য এতে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়।

স্পষ্টতই, সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বড় এবং গভীর একটি বৈশ্বিক সংকটের কালে ধনী দেশগুলোর প্রতি সবার প্রত্যাশা ছিল বেশি। শীর্ষ বৈঠকের ঘোষণায় সেই প্রত্যাশা পূরণে বড় ধরনের ঘাটতির কথা তুলে ধরেছেন বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের সময়ে বৈশ্বিক পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন। উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোতে টিকা দিতে বিলম্বের কারণে কোভিড–১৯-এর যে ধরন বদলাচ্ছে, তাতে করে টিকা পাওয়া পাশ্চাত্যের জনগোষ্ঠীও যে বেশি দিন নিরাপদ থাকবে না, সেই আশঙ্কাও জিইয়ে রইল। আর বৈশ্বিক রাজনৈতিক উত্তেজনা কতটা তীব্র হতে পারে, তার আলামতও পাওয়া যাচ্ছে চীনের প্রতিক্রিয়ায়।