প্রশ্নকাঠামোয় সমস্যা

হরতাল ও নানান কারণে নাকাল পরিস্থিতির মধ্যে জেএসসির পর এবার চলে এল পিএসসি অর্থাৎ প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা। আতঙ্ক শিশু-পরীক্ষার্থীদের চোখেমুখে। তারাও কি এসব বিড়ম্বনার কবলে পড়বে? জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা বলে তাদের উদ্বেগটা একটু বেশিই; অভিভাবকদের মধ্যেও উৎকণ্ঠা অনেক। তার ওপর যুক্ত হয়েছে নতুন বই ও প্রশ্নকাঠামোর পরিবর্তন। প্রশ্নকাঠামো প্রণয়ন করে থাকে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) নামের প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা নানা বিষয় বিবেচনায় এনে প্রশ্নকাঠামো প্রণয়ন করেন বলেই জানানো হয়। স্বভাবতই আশা করা যায়, শিশুমনস্তত্ত্বের বিষয়টি তাঁরা সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেন। কিন্তু নেপ প্রণীত এবারের প্রশ্নকাঠামো ভালোভাবে নিরীক্ষা করলে মনে হয়, কর্তৃপক্ষের মনোযোগের যেন ব্যত্যয় ঘটেছে।
একটি প্রশ্ন দিয়ে মূল আলোচনায় প্রবেশ করি: পঞ্চম শ্রেণীতে ইংরেজি পরীক্ষায় প্রথমেই গ্রন্থবহির্ভূত অনুচ্ছেদ (‘আন-সিন প্যারাগ্রাফ’) দিয়ে প্রশ্ন শুরু করা কি শিশুমনস্তত্ত্ব অনুমোদন করে? এটি আবার সাধারণ ‘আন-সিন’ নয়। এখানে সংলাপ, ছবি বা বিচিত্র অঙ্কনও থাকতে পারে বলে নেপ জানিয়েছে। যেখানে গ্রন্থভুক্ত অনুচ্ছেদ থেকেও প্রশ্ন থাকছে, সেখানে গ্রন্থবহির্ভূত শিশুমনে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী অনুচ্ছেদ দিয়ে প্রশ্নের সূচনা কেন? একইভাবে বাংলার ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটিই থাকছে পাঠ্যবই-বহির্ভূত অনুচ্ছেদসহ যোগ্যতাভিত্তিক। পরীক্ষার সূচনা-প্রশ্নে এভাবে ‘আন-সিন’ হোঁচট কোমলমতি পরীক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক নিশ্চয় নয়; যেখানে পঞ্চম শ্রেণীর পরীক্ষার্থীদের গড় বয়স প্রায় ১১ বছর।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রশ্নকাঠামোয় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, প্রশ্নের সংখ্যাবৃদ্ধিও ঘটেছে। গত বছর প্রাইমারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় বাংলায় ১৪ ধরনের প্রশ্ন ছিল, এবার সেখানে সংখ্যাটা হয়েছে ১৬; ইংরেজিতে গতবার ছিল ১২ ধরনের প্রশ্ন, এবার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১৫। বাংলায় বহুনির্বাচনী প্রশ্নের পরই গত বছর ছিল কবির নামসহ একটি কবিতা মুখস্থ লেখা। এবার অনুচ্ছেদ বা কবিতাংশ পড়ে সেখান থেকে চারটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অর্থাৎ কবির নামসহ কবিতা সম্পূর্ণভাবে মুখস্থ লেখার ব্যাপারটি আর থাকছে না। সেখানে থাকছে কবিতার চরণ এলোমেলো করে দেওয়া—সাজিয়ে লিখতে হবে শুধু।
ইংরেজিতেও একটি কবিতার আট চরণ মুখস্থ লিখতে হয়েছে গতবার। এবার সেটা সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে কি সৃজনশীলতার মানে মুখস্থকরণ থেকে পরীক্ষার্থীদের পরিপূর্ণভাবে সরিয়ে নেওয়া? বাংলা ও ইংরেজি কবিতা মুখস্থ করার যে সুন্দর সংস্কৃতিটি দীর্ঘদিন থেকে আমাদের মধ্যে চালু ছিল, সৃজনশীলতার ঝড়ে সেটা উড়ে যাবে? কেউ তর্ক তুলতে পারেন, ইংরেজি কবিতা মুখস্থ শিখতে দোষ কোথায়, শুধু পরীক্ষায় আসবে না! আমি বলব, পরীক্ষায় না এলে শিশুদের মধ্যে কবিতা মুখস্থ করার আগ্রহটি আর আগের মতো থাকে না।
বাংলা ও ইংরেজি কবিতা মুখস্থ করে সেটা কারণে-অকারণে আওড়ানো বা আবৃত্তি করা—যেটা এক অর্থে সৃজনশীলকর্মভুক্ত, এই প্রশ্নকাঠামোর মাধ্যমে তার অপমৃত্যু হলো বলে মনে করি। প্রশ্নকাঠামো বিচার করলে দেখা যাবে, বাংলা বিষয়ে এবার শিশুদের ‘কোনটি কোন পদ’ তা লেখার বিষয়টি থাকছে। আমি ভেবে অবাক হই, পঞ্চম শ্রেণীতে কীভাবে পদ চিহ্নিত করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলো? এটি সত্যি বেশ কঠিন এবং উচ্চতর শ্রেণীতে পাঠোপযোগী বিষয়।
অন্যদিকে, পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের বয়স ও পাঠধারণক্ষমতা বিবেচনা করে বোর্ড থেকে একটিমাত্র বাংলা বই দেওয়া হয়েছে, কোনো ব্যাকরণ ও নির্মিতি বই দেওয়া হয়নি। অথচ, পদসংক্রান্ত উল্লিখিত প্রশ্ন ছাড়াও একাধিক ব্যাকরণবিষয়ক প্রশ্নে ভার করা হয়েছে প্রশ্নকাঠামো। ইংরেজি প্রশ্নের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, প্রথমেই পাঠ্যগ্রন্থবহির্ভূত অনুচ্ছেদ দিয়ে শুরু; এরপর গ্রন্থভুক্ত অনুচ্ছেদ—এ দুটো থেকে মোট ছয়টি প্রশ্ন। তারপর অর্থপূর্ণ গল্প তৈরি; যতিচিহ্ন ও বড় হরফের ব্যবহার; ভুল-শুদ্ধ; ইংরেজিতে অনুবাদ; বাংলায় অনুবাদ; সংলাপ রচনা; নির্ধারিত সংকেত মেনে রচনা লিখন; ব্যক্তিপর্যায়ের চিঠি লেখা—কী নেই? নিশ্চয়ই, এসবই পরীক্ষা-উপযোগী, মানি। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণী যে বিবেচনা করতে হবে, এটা। তাই বলতে হয়, প্রশ্নের খড়্গ আর কত?
প্রশ্নের উত্তরকরণেও বিভ্রান্তি দূর করতে পারেনি নেপ। ইংরেজি ‘কম্পোজিশন’ রচনাপদ্ধতি নিয়ে শিক্ষককুলও বিভ্রান্ত। নেপ ‘কম্পোজিশন’ সম্পর্কে শুধু বলেছে, এটা হবে ‘শর্ট অ্যান্ড সিম্পল’। এর আগের বছরের প্রশ্নকাঠামোয় অনুচ্ছেদ রচনায় ৬০ থেকে ১০০ শব্দের কথা লেখা ছিল। ‘কম্পোজিশন’ সম্পর্কে নেপের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য প্রকাশ না পাওয়ায় শিক্ষকদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। এই মতপার্থক্যের বলি হতে পারে পরীক্ষার্থীরা। প্রশ্নকাঠামো প্রদানের ক্ষেত্রে বছরের ছয় মাস অতিক্রান্ত হলে তা অনুসরণ করা গ্রামের স্কুলগুলোর জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তাব হলো, প্রশ্নকাঠামোয় বিদ্যমান অসংগতিগুলো দূর করে পরিবর্তিত বা নতুন যা-ই হোক না কেন, যথাসময়ে প্রশ্নকাঠামো নির্ধারণ করে আগামী জানুয়ারি মাসের বই-উৎসবের দুই সপ্তাহের মধ্যেই তা দেশের স্কুলগুলোতে পাঠানোর ব্যবস্থা হোক।
বছরের প্রথম মাসে প্রশ্নকাঠামো জেনে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় সময় হাতে পাবেন শিক্ষকেরাও। শিক্ষার্থীদের এ বিষয়ে তাঁরা যেমন বিস্তারিতভাবে জানাতে পারবেন, তেমনি অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়াও গড়ে উঠবে।
ড. সৌমিত্র শেখর: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]