প্রিয় নাগরিকবৃন্দ, শুনুন...

গ্রিক নাট্যকার সফোক্লিস জন্মেছিলেন খ্রিষ্টের জন্মেরও ৪৯৫ বছর আগে এথেন্সের কাছাকাছি কলোনাস গ্রামে। পিতার নাম সফিলাস, যিনি যুদ্ধের বর্ম তৈরির কারিগর ছিলেন। পারস্য বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গ্রিস যখন যুধ্যমান, সে সময় সফোক্লিস তরুণ। সালামিসের বিখ্যাত যুদ্ধে আরেক নাট্যকার এস্কাইলাস যোগ দিয়েছিলেন সৈনিক হিসেবে, আর ওই যুদ্ধের বিজয়োৎসবে যুবকদের নেতৃত্বের ভার অর্পিত হয়েছিল সফোক্লিসের ওপর। এস্কাইলাসের কাছ থেকে সফোক্লিস ট্র্যাজেডি সম্পর্কে পাঠ নেন। পরবর্তীকালে বেশ কিছু ট্র্যাজিক নাটক রচিত হয় সফোক্লিসের হাতে। সেসবের মধ্যে ইদিপাস নাটকের কাহিনির মতো বেদনাদীর্ণ ও ভয়াবহ কাহিনি গ্রিক সাহিত্যে আর পাওয়া যায় না।

নাটকের শুরুতেই দেখা যাবে, থিবির রাজপ্রাসাদের সামনে অসহায় ভঙ্গিতে সমবেত হয়েছে থিবির আবালবৃদ্ধ নাগরিকেরা। নগররাষ্ট্র থিবিতে বেশ কিছুকাল ধরে চলছে মড়ক; মানুষ মরছে। উজ্জ্বল দিন নেই। রাত কালোর চেয়েও নিকষ। শস্যখেতগুলো নিষ্ফলা। রমণীরা সন্তান ধারণে অক্ষম। সমগ্র থিবি যেন এক বিরাট পোড়োভূমি। নাগরিকেরা আজ এসেছে তাদের রাজা ইদিপাসের কাছে। রাজাই তাদের শেষ ভরসা। কারণ, ইদিপাস একবার ভয়াল দানব স্ফিংসের জটিল প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থিবি নগরকে রক্ষা করেছিল।

ইদিপাস নগরবাসীকে আশ্বস্ত করেন, অভয় দেন। কারণ, তিনি তাঁর শ্যালক ক্রিয়নকে পাঠিয়েছেন ডেলফিতে অবস্থিত আপেলোর মন্দিরে তাঁর দৈববাণী জানতে—থিবির এই দুর্দশার কারণ কী? পরিত্রাণের উপায় কী? ক্রিয়ন ফিরে এসে ঘোষণা করেন আপেলোর দৈববাণী—পূর্বতন রাজা লেয়াসের হত্যাকারী থিবিতেই আছে এবং জন্ম দিয়েছে অসম্ভব এক পাপের। হত্যাকারীকে শনাক্ত করে তাকে নির্বাসিত করাই পরিত্রাণের একমাত্র পথ।

ইদিপাস তখনই শপথ নেন যে তিনি এই কাজটি করবেন। অলক্ষ্যে বসে হাসে নিয়তি। কারণ, নিহত রাজা লেয়াসের পুত্র এই ইদিপাস। ইদিপাসের জন্মের সময় দৈববাণী ছিল, এই শিশুটি পিতৃঘাতক হবে এবং মাকে বিয়ে করবে। লেয়াস তাই শিশুটিকে জন্মের পরপরই পর্বতচূড়া থেকে নিক্ষেপ করেছিলেন নিচে। নাটকের দৃশ্য পাল্টাতে থাকলে দেখা যায় সত্যানুসন্ধান ইদিপাসকে একটা অন্ধ আবেগের মতো গ্রাস করে ফেলেছে। ত্রিকালদর্শী অন্ধ ভবিষ্যৎবক্তা টিরেসিয়াসকে ডেকে আনেন ইদিপাস, দৈবজ্ঞানের মাধ্যমে তিনি যেন খুঁজে বের করেন অপরাধীকে। টিরেসিয়াস জানান, ইদিপাসই সেই অপরাধী। পিতৃঘাতক এবং মাতার অঙ্কশায়িনী। সত্য জানার পরও অন্ধ টিরেসিয়াস ও ক্রিয়নের সঙ্গে ইদিপাসের ব্যবহারে অহংকার ও দম্ভের প্রকাশ ঘটে। ট্র্যাজিক নাটকের অপরিহার্য কুশীলব ‘কোরাস’, যারা সমবেত স্বরে গান গায়, ইদিপাসকে তারা ব্যবচ্ছেদ করে এভাবে—

‘অহংকার গড়ে তোলে স্বেচ্ছাচারী মন,

অর্থ আর দম্ভ নিয়ে গর্বিত মানুষ’

উঠে যায় উচ্চতম গৌরব চূড়ায়—

তারপর ঘটে তার রূঢ় প্রপতন,

ধ্বংসের অতল গর্ভে সকলি হারায়।

অজাচারের পাপ স্পর্শ করে রানি জোকাস্টাকেও। আত্মহত্যা করেন তিনি। আর ইদিপাস কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে অন্ধ করেন নিজের দুই চোখ। শুরু হয় তাঁর নির্বাসনযাত্রা।

বাংলাদেশে ডেলফির মন্দিরও নেই, দৈববাণীও নেই। কিন্তু ইদিপাসের সময়ের থিবির জনগণ যে দিনরাত যাপন করেছেন, তার থেকে বাংলাদেশ কতটা অন্য রকম? এখানকার শস্যখেত নিষ্ফলা নয়। রোদ-বৃষ্টি গায়ে-মাথায় মেখে কেবল কৃষকদের প্রত্যক্ষ মেহনতে যে ফসল ফলে, সেই ফসলের উৎপাদন খরচ বাজার থেকে ঘরে ফেরত না আনতে পারার যাতনায় তাদের নৈরাশ্যের মুখাবয়ব নেই? নারীরা সন্তান ধারণে অক্ষম নন এখানে, সেই সন্তানদের সবাই কি রাষ্ট্রের সহযোগিতায় উচ্চশিক্ষার সিঁড়িতে পা রাখতে পারছে? একটি আসনের জন্য ভর্তিযুদ্ধে নামে ৩৯ জন। মানুষের জানমাল কি এই রাষ্ট্রে নিরাপদ? পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা মানবেতরভাবে বাঁচেন আর মারা যান পাশবিক মুনাফার চাপে। শাসক দল কিংবা বিরোধী পক্ষ—একবারও কি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, ভাবনা ও নাভিশ্বাস নিয়ে ভাবে? সংবিধান যে যার মতো করে কাটাছেঁড়া করেছেন গত ৪২ বছরে। গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও রাষ্ট্র পরিচালনা এমনকি নিজেদের দলীয় কর্মকাণ্ডের মধ্যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির কোনো প্রকাশ নেই। ক্ষমতায় যেকোনো মূল্যে টিকে থাকা এবং যেকোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার অপরাজনীতি সহিংস রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বে পরিচালিত দুই জোটের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণেই কি শুভবোধসম্পন্ন প্রগতিমনা দেশপ্রেম এখন কেবলই কথার কথা। যাদের অনেক বেশি সরব হওয়ার কথা ছিল প্রতিবাদে-প্রতিরোধে-বিক্ষোভে, সেই তারুণ্য ও যৌবনের শক্তি যেন দিশাহীন-নিষ্পৃহ। যারা বিবেক—দেশের কিংবা সমাজের সেসব সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সৃজনশীল মানুষেরা কোথায় মৌনতার দাসখত দিয়ে এসেছেন? এই নিদানকালে তাঁদের বলার বা করার কিছুই কি নেই? বিদেশি কূটনীতিকেরা এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন, আমাদের জাত্যভিমান কোথায় হারাল? আত্মমর্যাদায় কি একটুও বাধে না?

সহমত হব আমরা সবাই একবাক্যে যে সাধারণ মানুষ বড় নিরুপায় ঠিকই, কিন্তু দিন বদলায়ও। ভেতরে ভেতরে ধূমায়িত হচ্ছে ক্ষোভ। কার্যকারণ আবিষ্কার করতেও শিখছে মানুষ। আমাদের এখানে রাজা নেই বহুকাল। রানিরা আছেন। এসব দুর্দশার কারণ তাঁরা। তাঁদের দম্ভ। ক্ষমতার লোভ। ইদিপাসেরও তাই ছিল। নিয়তির চেয়েও ভয়ংকর হলো মানুষের সম্মিলিত শক্তি। মানুষ তার পক্ষের শক্তিকে ঠিক খুঁজে নেয়। পাতা উল্টে দেখুন। ইতিহাস সাক্ষী।

মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।