প্রথম আলোয় কলাম লেখক কামাল আহমেদ যথার্থই লিখেছেন। আমি স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী হিসেবে তাঁর লেখায় তুলে ধরা সেই সব দিনের চিত্রের সঙ্গে আরও তথ্য যোগ করতে চাই। আমি তখন মুজিববাদী ছাত্রলীগের উত্তর ছাত্রাবাস শাখার সাধারণ সম্পাদক। আমার বন্ধু আহসান হাবীব ছাত্রসংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও কামরুল ভাই সহসভাপতি ছিলেন। এইচএসসি পাস করে ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চেষ্টা করছিলাম, মহসীন হলে এক সিনিয়র ভাইয়ের রুমে উঠেছি নয়নের মাধ্যমে।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ঐতিহাসিক বটতলায় ছাত্রসভা চলছে। তখনকার ছাত্রনেতা কাদের ভাই, চুন্নু ভাই, মান্না ভাই, আকতার ভাই, আকরাম ভাই, মান্নান ভাইসহ অসংখ্য ছাত্রনেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এ কথা সত্য, এসব ছাত্রনেতার কোনো মোহ ছিল না। মিটিং শেষে শিক্ষা ভবনের দিকে মিছিল নিয়ে সারা ঢাকা শহর থেকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এসেছেন। এরশাদের তৎকালীন ঢাকার জিওসি মেজর জেনারেল আবদুর রহমানের নেতৃত্বে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আর্মি-পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। হঠাৎ একপর্যায় গোলাগুলি শুরু হয়। নিহত হন জয়নাল, জাফর, দীপালি সাহাসহ অনেকে। তখন স্ফুলিঙ্গের মতো খবর ছড়িয়ে পড়ল। যাঁরা কোনো দিন মিছিল করেনি, তাঁরাও দলে দলে কলাভবন চত্বরে চলে আসেন। সেখানে আনা হয় জয়নাল ও জাফরের লাশ।
তৎকালীন জাতীয় নেতাদের প্রায় সবাই এসেছিলেন অপরাজেয় বাংলায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও আসার কথা ছিল। হঠাৎ চারদিক আর্মিরা বেধড়ক মারধর শুরু করল। রাইফেল, বন্দুক ও লাঠির আঘাত থেকে মনে হয় সেদিন কেউ রক্ষা পায়নি।
আমরা যারা অপরাজেয় বাংলার কাছে ছিলাম, তারা কলাভবনে ঢুকে পড়লাম। একপর্যায়ে সেখানেও হামলা করা হয়। মারতে মারতে আমাদের আর্মির গাড়িতে তোলা হয়। তারপর ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়।
আমাদের ওপর কী অমানুষিক নির্যাতন করা হয়, যা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে, মনে হয় এখনো কীভাবে বেঁচে আছি! বেছে বেছে আলাদা করা হয় বিভিন্ন পর্যায়ের ছাত্রনেতাদের। যে আর্মি অফিসার এই দায়িত্বে ছিলেন, তিনি সম্ভবত সদয় হয়ে আমাকে এড়িয়ে গেলেন। আমাকে আলাদা করা হলো না। আমার পাশেই ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের এক নেতা (নাম মনে নেই), তাঁর চোখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়। উল্লেখ্য, কয়েক শ ছাত্রকে একটা হলরুমে গাদাগাদি করে রাখা হয়। তিন দিন অমানুষিক নির্যাতনের পর হঠাৎ ভোরবেলা নাম-ঠিকানা লিখে নেওয়া হলো। পরে বড় গাড়িতে করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ফজরের নামাজের সময় নামিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। আমি রংপুর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু সেই দিনের স্মৃতি, নির্যাতন এখনো ভুলতে পারি না।
ডা. মো. মশিউর রহমান
সহকারী অধ্যাপক, শিশুরোগ বিভাগ
দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ।