ফিরেও ফেরেনি যারা

এসব সাধারণ উদ্ধারকর্মীকে দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করার কি কেউ নেই?
এসব সাধারণ উদ্ধারকর্মীকে দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করার কি কেউ নেই?

শোকের কোনো অনুবাদ হয় না, ধারাভাষ্য হয় না। শোকার্তের বুকের তোলপাড় করা হাহাকার বাইরের দুনিয়ার কাছে বোবা হয়ে থাকে। রানা প্লাজার শূন্য গহ্বর, মৃত্যুর সুড়ঙ্গ, শেষনিঃশ্বাস আর মানুষপচা গন্ধমাখা বাতাস অনেকের ইন্দ্রিয়ে ধরা না পড়লেও স্বজনহারা, আহত আর উদ্ধারকর্মীরা এখনো তার মধ্যেই বাস করছেন। মানসিকভাবে এখনো আটকে আছেন সেই শূন্যতার গহ্বরে। এখনো অনেক উদ্ধারকর্মী স্মৃতির সুড়ঙ্গের মধ্যে বাঁচবার বা বাঁচাবার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের উদ্ধার করার কথা ভুলে গেছে সবাই। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ হয়েউঠেছিলএক ‘অন্য পৃথিবী’। পোশাকশিল্পের অমানবিক জগতের মধ্যে জন্ম নিচ্ছিলঅসাধারণমানবিক এক মহাকাব্য। এ রকমই কয়েকটি বোবা আর্তনাদের কথা: ‘নাই, মোর নুরালম নাই’ নুর আলমের বাবার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন সাংবাদিক শাহতাব সিদ্দীক অনীক। লালমনিরহাট থেকে মানুষটি আসেন ছেলেকে খুঁজতে। অনীককে পেয়ে বলছিলেন, ‘মোর ছাওয়াটাক একনা খুঁজি দেও ক্যা। জুয়ান ছাওয়া মোর। হামরা নালমনিইরহাট থেকি আসচং বাহে। মোর ছাওয়াটা খুব ভালো ফুটবল খেলাইত, পন্তা খাইত খুব। আকালি (লাল মরিচ) দিয়া পন্তা খায়া শোশানি উঠি যাইত। উয়ার বইন মজ্ক করি কইত ‘আকালি মাস্টার’। শুনি ছাওয়ালকোনা নাল (লাল) হয়া যাইত। আগ (রাগ) ছিল খুব। কিন্তু বইনটাক হারাম জেবনে ডাঙ্গায় (মারে নাই) নাই। বইনটা গার্লস ইসকুলত পরে। কেলাস এইট। সাইন্সের মাথা। মুই এলা কি করং বাহে। কোটে যাও? উয়ার মাও খালি মোবাইল করে। কয়, ‘মোর বেটাক আনি দেও। মুই কিছু জানো না...মোর বেটাক আনি দেও...মোক মারি ফেলাও।’ মুই কি কিছু জানি, তোমরা কন? ছাওয়া ঢাকাত চাকরি নেছে। তা ম্যালা মাইনসে তো এটে আছে, নোয়ায়? তা টিপিত দেখায় যে কিসের বলে বিল্ডিং ভাঙসে। মুই কও যে ওইটাই তো হামার নুরালমের ফেকটেরি, না? উয়ার বইন ফির স্কুল থেকি আসি কয় যে, ওইটাই হয়। কান্দে আর কয়, ‘আব্বা ভাইয়াক বাঁচান, খালি কান্দে আর কয় ...মুই কও যে আচার্য (আশ্চর্য) ঘটনা। মুই বিশ্বাস যাও নাই, হারাম! বাস ধরি চলি আসনু সাভার। আসনু তো, মুই এলা কোঁটে খুঁজি? মাইনসেক কই, তোমরা বারে হামার নুরালমক খুঁজি দিবার পাইমেন? মুই নেখাপড়া জানো না বাহে, দ্যাও ক্যা একনা খুঁজি? কয় যে হাসপাতালত দেখ। দেখছি ওটে। নাই, মোর নুরালম নাই। কয়, পাইমেন চাচা পাইমেন। একনা ওয়েট করেন। কয়, বিস্কুট খান চাচা। ফিরি বিস্কুট। খাইমেন? মুই শুনি কান্দি ফেলাইসং। মুই জীবনে কান্দং নাই বাহে। বিস্কুট দেখি কান্দি ফেলাইসং। মুই বিস্কুট খাবান নই। নুরালমের মাও নালমনিত না খায়া আছে বারে। না খাও তোমার বিস্কুট। কয়, খাও ক্যা চাচা, পরে খোঁজেন তোমার বেটাক; এইগুলা খাবার মাইনসে গাড়িত চড়ি আসি দিয়া গেইছে। মুই শুনি ফির কান্দি ফেলাইসং। মোর আর ভালো নাগসে না বারে। আচ্ছা কন তো, কেমন বিল্ডং বানে থুইসেন? ওইটা বিল্ডং কি খ্যার (খড়) দিয়া বানাইছেন? কায় বানাইছে ওখান? ভাঙি পড়ে কেমন করি? ওইটা কি ভাঙ্গাই আছলো? ভাঙ্গা বিল্ডং বানেয়া তোমরা ফেটকারি খুলি বসছেন ফির?

মুই ওই ভাঙ্গা বিল্ডং দেইখপার গেইনু, তা কিসের বলে ওটেও ডাঙ্গাডাঙ্গি (মারামারি)। বিশ-পঁচিশ মিনিট ওয়েট করি ঢুকপার গেসি, এখান পুলিশ গেরাভিটি (দাপট) দ্যাখে কয়, খবরদার! কিসের বলে ডিস্টাব হয়। মুই কও বাহে, মুই এটে খাড়ে থাকিম, তোমরা একটু দ্যাখ ক্যা হামার নুরালম কোঁটে? মুই তোমার পাও ধরোঁ। পুলিশ কয়, পাইমেন, রেডি কর। মুই রেডি করোঁ। মুই করোঁ। কিন্তু মোর আর ভালো নাগছে না। মোরটে নুরালমের ফটো আছে। দ্যাখেন ক্যা তোমরা? চেহারাখ্যান দ্যাখছেন? আজার ছাওয়াল (রাজপুত্র) নাগে না? আগত (আগে) ফরসা আছলো খুব। উয়ার দাদিও আছলো ফরসা। নুরালম নামটা ওই দাদিই দেছে। তা, তোমরা একটু নেখি (লিখে) ন্যাও। মোর মোবাইল আছে এখান (একটা)। ব্যাটায় কিনি দিছলো। তোমরা নুরালমক পাইলে মোবাইল করমেন হামাক? কিন্তু মোর আর ভালো নাগছে না। মোর খালি চখত ভাসতছে...মোর ব্যাটা।’’ সূত্র:শাহবাগ আন্দোলনের বুলেটিনরাস্তা ‘আত্মার একটা অংশ যেন ওখানে’ আসমা আক্তার লিজা নাট্যকর্মী, লেখক। বিয়ের গয়নাবেচা ছিয়ানব্বই হাজার টাকার অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে ছুটে গিয়েছিলেন। আর ফিরতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ছিলেন। এখনো আহত ও স্বজনহারাদের পাশে সাধ্যমতো থাকছেন। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন: ‘চতুর্থ দিনের কথা। ভবনটা আরও চেপে আসছে। একটা জায়গায় তিনটা লাশ পড়ে আছে। সরু জায়গা। পুরুষরা কেউ যেতে পারছে না। তখন রাত তিনটা, বহু কষ্টে ঢুকে তিনটা লাশ ব্যাগে ভরে বের করে আনি। আমার পিঠে চে গুয়েভারার ছবিঅলা একটা ব্যাগ থাকত। তাতে পচা মাংস, রক্ত লেগে ছিল। সেই গন্ধ এখনো লেগে থাকে নাকে, বমি হয়। খেতে পারতাম না। বারেবারে ওখানে চলে যেতাম। আত্মার একটা অংশ যেন ওখানে রয়ে গেছে। এখনো যাই, পাশের বিল্ডিংয়ের গায়ে গর্তগুলো এখনো আছে। সেদিকে তাকায়া থাকি আর ভাবি কোনটা দিয়ে ঢুকেছিলাম, কোনটা দিয়ে বের হয়েছিলাম। একদিনের ঘটনা। ভেতরে টর্চ নিয়ে যাচ্ছিলাম। রাত চারটা। হঠাৎ একটা চুড়ি পরা হাত আমার হাত ধরে টান দিল। ভয়ে জ্ঞান হারাই। ঝর্ণা নামে একটা মেয়েকে উদ্ধার করেছিলাম; ওর বোন মারা গেছে। সুড়ঙ্গের ভেতর ও বলেছিল, ‘বুনু পানি খাব’। এখন আমাকেই ওর সেই হারানো বোন ভাবে, দেখলেই পানি খেতে চায়। হাসপাতালে এনে রেখেছি। রাতে ঘুমায় না। চিৎকার করে। একদিন আমাকে পেয়ে পেটের ওপর দুই ঘণ্টা ঘুমিয়েছিল। ১৪ বছরের ইয়ানুরের দুই পা অচল। ইয়ানুর, সাকিব, রিমি, মিম, সজীব, সবুজ; ওরা এমনভাবে মা ডাকে, স্থির থাকতে পারি না। সবুজ তো বুঝেই না যে, আমি ওর মা না। একজনের ফুফুকে এনে তার কাছে সবাইকে রেখেছি সাভারে। আমার কাছে এসেও থাকে। ৪টি অন্তঃসত্ত্বা মেয়েকে বাঁচাতে পেরেছিলাম। ওরা বলে, মেয়ে হলে ওদের নাম রাখবে লিজা। কেউ শুনতে চায় না এসব কথা। বলে পাগল, বলে আমি ট্রমাটাইজড—মানসিক অসুস্থ। ট্রমাটাইজড হয়ে যদি মানুষকে ভালোবাসা যায় তাহলে আমি ট্রমাটাইজডই থাকতে চাই।’ অভাগা দেশের দুর্ভাগা বীর! মোটর মেকানিক শফিউল আলম শফিক (৩৫)। দাঁড়ানো যায় না এমন ছোট একটা দোকান আছে ইস্কাটনে। এখন আর সেখানে বসতে পারেন না। কিছুই ভালো লাগে না। রানা প্লাজার ঘটনা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে চলেছেন। বলেন, ‘বই বের করব, সবাইকে জানাব।’ কেমন আছেন জানতে চাইলে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে বাম কান ফেটে গেছে। ঘুমের মধ্যে চিৎকার শুনি। দেখি: হাত-পা কাটছি, টুকরা টুকরা দেহ এক করছি। ভয় পেয়ে উঠতে গিয়ে দেয়ালে বাড়ি খাই। কান ফেটে রক্ত বের হয়। বাম কানে আর শুনি না। ঘুমও হয় না। আমি যে আর্তনাদ দেখছি, ব্যাঙের মতো হয়া গেছি, ছোট্ট হয়া গেছি, ইঁদুরের মতো ঢুকছি সুড়ঙ্গের ভেতর। কোনো লাশ বসে আছে, কোনো লাশ তাকায়া আছে। ডর-ভয় ছিল না। এক কাপড়ে ১৬ দিন। মাথায় বোল্ডার পড়ল, রডের গুঁতা খেলাম। ক্রেনের বাড়ি খেয়ে হাসপাতালে ১১ দিন ছিলাম। ব্যথায় এখনো কষ্ট পাই, শুইতে পারি না। দৃশ্যগুলো ভুলতে পারি না। একটা লাশ যিশুর মতো ঝুলন্ত ছিল। একসঙ্গে ২০-২৫টা করে লাশ। ভয়ংকর। ছেলে না মেয়ে বোঝার উপায় নাই। জীবিতদের উদ্ধার শেষে ডোমের খাতায় নাম লেখাই। লাশের টুকরা টুকরা অংশ এক করি। একটা জীবিত মানুষ বের করতে পারলে ভাবতাম, একটা পৃথিবী জয় করছি। সরকার বলছিল সার্টিফিকেট দেবে, সাহায্য করবে। কিন্তু কই? সে সময় কদর ছিল, এখন আর নাই। মাথা স্থির থাকে না। ছোট দুই ছেলেমেয়ের কথাও ভালো করে মনে আসে না। কুতুববাগ দরবার শরিফে শুয়ে থাকি। বাবা-ছোট ভাইরা আমার পরিবার চালায়। আমাদের মতো উদ্ধারকর্মীরা অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ। সবাই তো গরিব মানুষের ছেলে। টাকার অভাবে মন স্থির থাকে না। ইচ্ছা হয় একদিকে চলে যাই।’ শফিককে যখন পেলাম, তখন তিনি এক বড় নেতার দেওয়া মিসকিন খাওয়া খেতে গেছেন। ১০০ টাকাও নাকি পাবেন। হায়রে অভাগা দেশের দুর্ভাগা বীর! কতজনের কথা বলব? সাভারের রাজমিস্ত্রি রফিকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয় না। কথা বলেন তাঁর স্ত্রী: ‘হে আর কাজকর্ম করে না। অনেক কথা বলে, যা বলার মতো না। মাইনসের সঙ্গে রাগারাগি করে, মারামারি করে। কান্নাকাটি করে। বাসায় থাকে না। রানা প্লাজায় যায়া বসে থাকে। বলে, “ওখানে আমার হাজার হাজার মা-বোন আছে। আমি ওখানেই থাকব।” ওখানে ছাড়া কোথাও নাকি ভালো লাগে না।’ কোনো সাহায্য পাননি তিনি। চারটি ছেলেমেয়ে। শেষ ছেলেটি হয়েছে ১৩ দিন হলো। ঘরে দানাপানি নেই। রফিকের স্ত্রী বলে যান, ‘সংসার কীভাবে চলে, তা বলা সম্ভব না। এক বেলা দুই বেলা খাই। চোখে অন্ধকার দেখি।’ এই গল্পের কোনো শেষ নেই। রানা প্লাজার অন্ধিসন্ধিতে হাজার হাজার মানুষের হাজার বছরের সমান অমানুষিক অভিজ্ঞতা হয়েছে। উদ্ধারকর্মী এজাজ উদ্দিন মারা গেছেন বিদেশে চিকিৎসার সময়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিখোঁজ থাকার পর বাবুর লাশ পাওয়া গেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরই এক বারান্দায়। কৃষক ইউসুফ ঢাকায় এসে রানা প্লাজায় উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। গায়ের ওপর বিম পড়ে তিনি এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ছাত্র ফেডারেশনের উদ্ধারকর্মী দলের হিমুর মনে হয়: ‘আমি আসলে লাশের শরীর-রক্তমাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে টুকরা করে সামনে নিয়ে বসে আছি। আমার সবচেয়ে বড় শত্রুরও যেন কখনো এই উপলব্ধি না হয়।’ রানা প্লাজার ওই জায়গাটায় এখন শূন্য গহ্বর। সেখানে বৃষ্টির পানি জমেছে। রফিক যখন-তখন সেই পানিতে হাঁটাহাঁটি করে আর কথা বলে। শফিক বিবাগি। নুর আলমের বাবা এখনো খুঁজে ফিরছেন রাজপুত্রের মতো ছেলেকে, যে আর তার বোনের খুনসুটিতে কপট রাগে গাল লাল করে ফেলবে না। রানা প্লাজা লিজাকে দিয়েছে অফুরান কান্না আর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে, ভাইবোনের দায়িত্ব। এদের সবার জীবনের ওপর রানা প্লাজা এখনো ধসে চলেছে। সেই অন্ধকার গহ্বর থেকে সেদিনই তাঁরা মুক্তি পাবেন, যেদিন এই রাষ্ট্র ও সমাজ তাঁদের যন্ত্রণার অংশীদার হতে পারবে।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]