ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠতে পারে তালেবান

আইএসআইএর আশা মার্কিন সেনা ফিরে যাবে আর তালেবান নিরাপদে কাবুলের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে
ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রয়াত প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল এ কথা গর্বের সঙ্গে বলতেন, যখন আফগানিস্তানের ইতিহাস লেখা হবে, তখন এ কথাও নথিভুক্ত থাকবে যে আইএসআই আমেরিকার সহায়তা নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করেছিল। এরপরই তিনি চাতুরী করে বলতেন, পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিকেরা এটিও লিখে রাখবেন যে একদিন এই আইএসআই আমেরিকার মদদ নিয়ে আমেরিকাকেই হারিয়ে দিয়েছিল।

গুলের এমন গর্ব অনুভব করা অমূলক নয়। কারণ, সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে কুখ্যাতি আছে যে উর্দি খুলে ফেলার পর তাঁরা তাঁদের অতীতকে আরও বেশি মহিমান্বিত করে স্মরণ করেন। আফগানিস্তানে মোতায়েন করা সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইরত জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ও পয়সাকড়িতে সমৃদ্ধ করা এবং এর মাধ্যমে ক্রেমলিনকে আফগানিস্তানের মাটি থেকে তার বাহিনীকে গুটিয়ে নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া আইএসআইয়ের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বলে তিনি যে দাবি করেছিলেন, তা সর্বান্তঃকরণে সঠিক।

পরবর্তী সময়ে একই প্রক্রিয়ায় এবং একই ব্যক্তিদের কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান আফগানিস্তানে একটি মুজাহিদিন গোষ্ঠী সৃষ্টি করে ও তাদের অর্থায়ন করে। সেই মুজাহিদিন গোষ্ঠীই হচ্ছে তালেবান, যারা খুব দ্রুতই আফগানিস্তান দখল করে এবং আইএসআইএর সহযোগী শক্তি হিসেবে গোটা দেশ শাসন করতে শুরু করে।

তবে গুল ও তাঁর লোকদের সেই সুখকর অনুভূতি বেশি দিন টিকল না। যখন ওসামা বিন লাদেন তালেবানের নতুন ‘ইসলামি সাম্রাজ্যে’ গেড়ে বসলেন এবং সেখান থেকে আমেরিকায় নাইন–ইলেভেনের হামলার নির্দেশ দিলেন। পরে আমেরিকার তীব্র অভিযানে তালেবানের পতন হয় এবং ওসামা বিন লাদেন নির্বাসিত হন পাকিস্তানে। সেখানে সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা স্থাপনায় আইএসআইয়ের অধীন ছিলেন তিনি। অ্যাবোটাবাদে সেই নিরাপত্তা স্থাপনাতেই লাদেনকে শনাক্ত করে আমেরিকা এবং ২০১১ সালে মার্কিন বিশেষ বাহিনী তাঁকে হত্যা করে, যা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি আইএসআই। কিন্তু আফগানিস্তানে দীর্ঘ অভিযানে ক্লান্ত হয়ে পড়ল আমেরিকা এবং তাদের বিরুদ্ধে পুনর্গঠিত হতে তালেবানকে সহযোগিতা করল আইএসআই। তখন ঘটনা আবার পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষেই চলে এল। নাইন-ইলেভেন হামলার ২০ বছর পূর্তির মধ্যেই মার্কিন সেনাবাহিনীকে পুরোপুরিভাবে আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আমেরিকা সন্ত্রাসীদের মূলে আঘাত হানতে সংকল্পবদ্ধ, এটি বোঝাতেই ওই তারিখ দিয়ে আমেরিকা প্রতীকী বার্তা দিলেও এ কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়ায় তাদের যে ইচ্ছার অভাব রয়েছে, তা বোঝা যাচ্ছে।

আমেরিকা তার আত্মসমর্পণের বিষয়টি ঢাকতে আফগানিস্তানে নিজের উত্তরসূরি বসানোর ব্যবস্থা তৈরি করে যেতে পারে। তবে কোনো অর্জন ছাড়াই দেশটি ছেড়ে আসতে হচ্ছে, এটা তার পরাজয়। তালেবান এখন আরও শক্তিশালী হয়ে আবার কাবুলের ক্ষমতা নিতে প্রস্তুত। হামিদ গুলের ভাষ্য হিসেবে, এটাই হচ্ছে আমেরিকার সহায়তায় আমেরিকাকেই পরাজিত করা। কারণ, পাকিস্তান দুই দশক ধরে মার্কিন সামরিক সহায়তা পেয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ১১ বিলিয়ন ডলার।

আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা আইএসআইয়ের। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে মোকাবিলা করতে আফগানিস্তানে তার কৌশলগত অবস্থান তৈরি করা জরুরি। ফলে কাবুলে তালেবান শাসন (বা তালেবান প্রভাবিত জোট সরকার) হচ্ছে আইএসআইয়ের জন্য সবচেয়ে বড় নিশ্চয়তা। তবে কাবুলে অর্জন নিয়ে উদ্‌যাপন সংবরণ করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে হামিদ গুলের উত্তরসূরিদের। কারণ, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কারণে ওয়াশিংটন থেকে বড় সুবিধা গ্রহণের সুযোগ হারাবে পাকিস্তান। আইএসআই জানে, তাদের সহায়তায় তৈরি সশস্ত্র যোদ্ধাদের ওপর সব সময় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না। ম্যারি শেলির ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে সেটা।

মার্কিন সেনা ফিরে যাবে আর তালেবান নিরাপদে কাবুলের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, আইএসআই এটাই আশা করে আছে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সংস্থাটি মনে করতে পারে, কাবুলে সাফল্যের কারণে সংস্থাটির পূর্ববর্তী অপরাধ ক্ষমা করে দেবে পাকিস্তানি তালেবান। তাহলে তো শান্তি ফিরল। মানে, আফগানিস্তান আইএসআইয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল আর পাকিস্তানি তালেবানও সেনাবাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করে দিল, তারাও আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগ দিল ‘প্রকৃত শত্রু’ ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্রতর করতে।

তবে সেটা হতে পারে আইএসআইয়ের দুঃস্বপ্নও। আফগানিস্তানে ভাই-বেরাদরের সাফল্যে উজ্জীবিত হতে পারে পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোও। পাকিস্তানেও একই লক্ষ্যে সন্ত্রাসী হামলা শুরু করতে পারে তারা। ‘যদি আফগানিস্তানে একটি ইসলামি শাসন চলতে পারে, তাহলে পাকিস্তানে আমরা কেন সেটা পারব না?’ এমন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে তাদের ভেতর। তবে এটা সত্য, কোনো রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সে সম্ভাবনা কম, যেটি আফগানিস্তানে তালেবানের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। যদিও তারা চাইলে যথেষ্ট ক্ষতি করতে পারে, পাকিস্তানে সামরিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দেশটির জনগণের ভেতর যে অসন্তুষ্টি, তার মধ্য দিয়ে। তেমনটি যদি ঘটে থাকে, তাহলে হামিদ গুলের ভাবনাকে আরেকটু বাড়িয়ে আমরা বলব, আইএসআইয়ের নিজের চরের সহায়তায় তার নিজেরই পরাজয় ঘটল, নিদেনপক্ষে তার মর্যাদাহানি হলো।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর ভারতের লোকসভার সদস্য, কংগ্রেস নেতা ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী