বসবাসের জন্য রাজশাহী, পাখির জন্য ‘বার্ডশাহী’

চখাচখি

২০ বছর আগেও রাজশাহী ছিল অপরিচ্ছন্ন এক নগর। সড়ক ছিল সরু সরু। সড়কবাতিও পর্যাপ্ত ছিল না।সেই রাজশাহী এখন দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন এবং বসবাসের উপযোগী নগর।পরিকল্পনা আর আন্তরিকতা থাকলে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে বাংলাদেশেও যে একটি সুন্দর নগর গড়ে তোলা যায়, তার দৃষ্টান্ত রাজশাহী।

সম্প্রতি রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। রাজশাহী নিয়ে যাদের সঙ্গেই কথা হলো, সবাই এ নগর নিয়ে খুব স্বস্তির কথাই শোনালেন। রাজশাহী রেলস্টেশনের কাছে জাতীয় চার নেতার এক নেতা শহীদ কামারুজ্জামানের নামে একটি চত্বর। সেখানে এক বৃদ্ধ ডিম বিক্রি করছিলেন। আশপাশে কোনো ময়লা নেই। তিনি বললেন, ‘এখন আর রাস্তায় ময়লা ফেলা যায় না। সিটি করপোরেশনের লোকজন ব্যবসা করতে দেবে না।’ পাশেই এক ডিম ক্রেতা বললেন, ‘দিনে-রাতে কয়েকবার ঝাড় হয় সড়ক। কোথাও ময়লা জমে থাকলে সিটি করপোরেশনে খবর দিলেই এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।’ সিটি করপোরেশনের মেয়র, স্থানীয় সাংসদ, বিভাগীয় প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে রাজশাহী একটি আদর্শ শহর হয়ে উঠছে। রাজশাহী এখন অনুকরণীয় নগর। রাজশাহীর সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগও খুব ভালো। পরিচ্ছন্নতা, নান্দনিকতা এবং অবাধ নাগরিক সুবিধাই এ শহরের প্রাণ। পরিকল্পিতভাবেই বিকশিত হচ্ছে এ নগর।

দুদিন গিয়েছিলাম পদ্মা নদী আর পাখি দেখতে। প্রথম দিন নৌকার মাঝি ছিল অনীক। হাতে তার দুরবিন। নিজেও সে পাখির ছবি তোলে। অনীকের বাবা, ছোট ভাই সবাই মাঝি। অনেক দিন পর পদ্মায় গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। গত কয়েক বছরে নদীর অবস্থা আরও করুণ হয়েছে। নদীর তলদেশ থেকে চর কোথাও কোথাও ২৫-৩০ ফুট উঁচু। নদী থেকে মনে হয় বালুর পাহাড়। ফাল্গুন মাসেই পানি অনেক কমে গেছে। বৈশাখ নাগাদ আরও কমে যাবে। নদী থেকে বালু উত্তোলন চলছে।
পদ্মায় পাখিদের মধ্যে প্রথমেই চোখে পড়ল চখাচখি। কোথাও জোড়ায় জোড়ায় কোথাও ঝাঁকে ঝাঁকে। আরও খানিকটা সামনে যেতেই বড় খোঁপা ডুবুরির দেখা মিলল। তারপর পেলাম গাঙচিল। ক্ষিপ্র শিকারি পাখি শাহিন দেখলাম পদ্মার চরে।

নদীর ভেতরে ২৫-৩০ ফুট উঁচু চরে নিয়ে গেল অনীক। দুজনে হাঁটতে থাকলাম। চরের মধ্যে হাঁটা খুবই কঠিন। অনীক পাখি খুঁজছে, আমি দেখছি নদীর করুণ চেহারা। নদীর বুকে কোথাও কোথাও মসুর চাষ করা হয়েছে। কাশের নাড়াও আছে। অনেক সময় ধরে হাঁটতে হাঁটতে ছোট কান প্যাঁচার সন্ধান পাওয়া গেল। অনীক বলছে এ বছর এই নিয়ে সপ্তম দিন এই প্যাঁচা দেখা গেল। সাইবেরিয়ান শিলাফিদ্দাসহ বিভিন্ন রকম ছোট জাতের পাখিও আছে। এরপর দেখা গেল একঝাঁক পাখি চরের ধানখেতের আলে বসে আসে। কালো মাথা কাস্তেচরা, ধূসর বক, ছোট বক, বড় বক, শামুকখোল। লম্বা পা তিশাবাজ এবং নীলগলা ফিদ্দাও পেলাম নদীর মাঝচরে।

রওনা হওয়ার সময়ই অনীক সাবধান করেছিল, এই জুতো পরে চরে যাওয়া ঠিক হবে না। তার কথাই সত্য হলো। জুতার অবস্থা এতই খারাপ হলো যে শরীর যদি-বা চলে জুতা আর চলে না। বাধ্য হয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। ফেরার পথে গিরিয়াসহ কয়েক ধরনের হাঁস দেখতে পেলাম।

দুদিন পর আবারও পদ্মায় গেলাম। এবারে সঙ্গী হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক। মোস্তফা তারিকুল আহসান, সৈকত আরেফিন ও উদয় শংকর। এরা প্রত্যেকে লেখক। আজ আমাদের নৌকার মাঝি নুর মোহাম্মদ নুরু। নুরুও অনীকের মতো। নৌকা চালনার পাশাপাশি পাখির ছবি তোলে। প্রায় দুই ঘণ্টা টানা যন্ত্রচালিত নৌকা চালিয়ে সে আমাদের নিয়ে গেল বিজিবি ক্যাম্পের কাছাকাছি। সেদিনও চরে বিভিন্ন রকম পাখি চোখে পড়ল। আমাদের ইচ্ছে ছিল লাল মাথা ভূতি হাঁস দেখার। পেয়েও গেলাম। সঙ্গে আরও কয়েক প্রজাতির হাঁস।

কাঠশালিক

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পাখি দেখতে গিয়েছিলাম দুদিন। একদিন সূর্য ওঠার আগেই বেরিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক রাশেদ সুখন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক রহমান রাজু। সবুজ বক, ডাহুক, জলমোরগ এবং বামনী কাঠশালিকসহ অনেক পাখি দেখলাম। বামনী কাঠশালিক রাজশাহীতেই কেবল সহজলভ্য। দেশের আর কোথাও তেমন একটা দেখা যায় না। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ সালেহর সঙ্গে কথা হলো। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি প্রধানত নিজের তোলা পাখির ছবি নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রদর্শনী করে আসছেন। তার কাছে জানালাম, ক্যাম্পাসেই তিনি দুই শতাধিক প্রজাতির পাখির ছবি তুলেছেন। বিভিন্ন প্রজাতির পাখির ছবিতে ভর্তি তাঁর কার্যালয়। পাখিবিষয়ক দুটি বইও লিখেছেন তিনি। দুর্লভ প্রজাতির প্যাঁচার সন্ধান পাওয়া গেছে এই ক্যাম্পাসে। তিনি বললেন, ক্যাম্পাসে যাতে পাখি আরও আসতে পারে, থাকতে পারে, সে জন্য প্রশাসনের আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।

দীর্ঘদিন ধরে পাখির ছবি তোলেন হাসনাত রনি। তিনি ফেসবুকে রাজশাহীর পাখির ছবি পোস্ট করলে ঠিকানা হিসেবে লেখেন ‘বার্ডশাহী’। রাজশাহীতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির বসবাস। যাঁরা সারা দেশে পাখির ছবি তোলেন তাঁরা বছরে অন্তত একবার হলেও রাজশাহী যান পাখির ছবি তোলার জন্য। সারা দেশে মোট কয়েকটি এলাকায় অনেক পাখির সন্ধান পাওয়া যায়। তার মধ্যে রাজশাহী অন্যতম। সেই বিবেচনায় হাসনাত রনির সঙ্গে একমত প্রকাশ করে রাজশাহী সম্পর্কে বলাই যায় পাখির জন্য ‘বার্ডশাহী’। সারা দেশে এখন পর্যন্ত রেকর্ড হয়েছে ৭১৪টি পাখি। হাসনাত রনি জানান, ‘রাজশাহীতে এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩০০ প্রজাতির পাখি দেখা গেছে।’ রাজশাহী জেলাতেই যদি দেশের মোট প্রজাতির অর্ধেক প্রজাতির পাখি থাকে, তাহলে সেই জেলাকে ‘বার্ডশাহী’ বললে অত্যুক্তি হয় না।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail. com