বহুবিবাহের বিধানগুলো নতুন করে পর্যালোচনা দরকার

২০১৯ সালে মিসরের শীর্ষ ইসলামিক প্রতিষ্ঠান আল-আজহারের প্রধান ইমাম ফতোয়া দেন যে বহুবিবাহ নারীর প্রতি ন্যায়বিচার করে না। যাঁরা বহুবিবাহকে সমর্থন করেন, তাঁরা ইসলামের ভুল অনুশীলন করছেন। তিনি বলেন যে ইসলামে একাধিক নারীকে বিয়ে করা যাবে তখনই, যখন তাঁদের সবার প্রতি ন্যায্যতা দেখানো সম্ভব হবে। কিন্তু বহুবিবাহের মাধ্যমে তা করা সম্ভব নয় (দ্য ইনডিপেনডেন্ট, ৩ মার্চ ২০১৯)। অনেক দিন থেকেই মিসরসহ বিশ্বের অনেক মুসলিমপ্রধান দেশে বহুবিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামি আইনের এ ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

বহুবিবাহ ইসলামে পুরোপুরি নিষিদ্ধ কি না, এ বিষয়ে বিতর্ক আছে। তবে ইসলাম যে বহুবিবাহকে নিরুৎসাহিত করে, এ বিষয়ে অনেকেই একমত। ইসলামি আইনের বেশির ভাগ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, ইসলাম একগামিতাকে আদর্শ বিবেচনা করে, বহুবিবাহ ব্যতিক্রম। বহুবিবাহ বিষয়ে ইসলামের এ অবস্থানের প্রতিফলন বেশ কয়েকটি ইসলামিক রাষ্ট্রের আইনেও দেখা যায়। কিছু রাষ্ট্র বহুবিবাহকে শরিয়তবিরোধী ব্যাখ্যা দিয়ে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে। তিউনিসিয়া যেমন এ যুক্তিতে বহুবিবাহকে বাতিল করে দিয়েছে যে যেহেতু ইসলামে বহুবিবাহকে আবশ্যক করা হয়নি, শুধু শর্ত সাপেক্ষে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাই এ প্রথাকে রাষ্ট্র চাইলে জনস্বার্থে বিলুপ্ত বা পরিমার্জন করতে পারে।

অন্যদিকে অনেক মুসলিমপ্রধান দেশ বিয়ের চুক্তিতে স্বামীকে দ্বিতীয় বিয়ে না করার শর্ত আরোপ করার এখতিয়ার স্ত্রীকে দিয়েছে, যে শর্ত ভঙ্গ করলে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারেন বা বিয়ের শর্ত অনুযায়ী অন্য কোনো প্রতিকার আইনগতভাবে চাইতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জর্ডান, লেবানন বা মরক্কোর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি এমন অনেক দেশ রয়েছে, যেখানে বহুবিবাহকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ না করলেও আইনের মাধ্যমে বিধিনিষেধ আরোপ করে পরিধিকে সীমিত করা হয়েছে। ইরাকে বিচারক চাইলে একজন পুরুষের একাধিক বিয়ের অনুমতি প্রত্যাখ্যান করতে পারেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি প্রমাণ করতে পারছেন যে একাধিক বিয়ের জন্য তাঁর যথাযথ কারণ এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা রয়েছে।

একইভাবে বাংলাদেশ বহুবিবাহকে নিষিদ্ধ না করলেও পাকিস্তান আমলে করা ১৯৬১ সালের মুসলিম ফ্যামিলি লজ অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে কিছু পদ্ধতিগত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে একজন মুসলিম পুরুষকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নিয়ে গঠিত সালিসি কাউন্সিলের অনুমতি নিতে হবে। এ সংস্কার আইন কিন্তু তিন তালাকসহ আরও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রচলিত মুসলিম পারিবারিক আইনের ব্যাখ্যায় পরিবর্তন এনেছে। তবে এ আইন প্রণয়নের ইতিহাস কিন্তু বহুবিবাহ-সংক্রান্ত বিতর্কের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী যখন তাঁর প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহিত থাকা অবস্থায় আরেকটি বিয়ে করেন, তখন পাকিস্তানে বহুবিবাহের বিরুদ্ধে নারী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। আন্দোলন এতটাই তীব্র হয় যে ইসলামিক পারিবারিক আইনের প্রচলিত ব্যাখ্যায় নারীর অবস্থান পর্যালোচনা করে সুপারিশ প্রদানের জন্য পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশনের সুপারিশেই ১৯৬১ সালের আইনটি পাস করা হয়। বর্তমানে এটি বাংলাদেশেও প্রযোজ্য।

এ আইনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বহুবিবাহের মতো বৈষম্যমূলক একটি প্রথাকে রোধ করা। এ উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়নি বলা যায়। প্রথমত, অনেক সময় দেখা যায়, ঢালাওভাবে কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই সালিসি কাউন্সিলে বহুবিবাহের অনুমতি দিয়ে দেওয়া হয় (আলমগীর মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন, ১৯৯৯)। প্রথম স্ত্রীর সম্মতি আছে কি না, আবেদনে তা লেখার কথা রয়েছে, তবে আসলেই একজন স্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন কি না, সেটি যাচাইয়ের কোনো বিধান নেই। ২০১২ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একটি প্রতিবেদন বলছে, স্বামী একাধিক বিয়ে করেছেন, এমন ৪০ জন বাংলাদেশি মুসলিম নারীর কেউই তাঁদের স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে জানতেন না। কোনো ধরনের সালিসি কাউন্সিলের অভিজ্ঞতাও তাঁদের ছিল না। আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো, আইনটিতে অনুমতি দেওয়ার এখতিয়ার কোনো বিচারিক আদালতকে না দিয়ে দেওয়া হয়েছে একটি নন-জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে। অনেক ক্ষেত্রেই সালিসি কাউন্সিলগুলোতে পুরুষ সদস্যের প্রাধান্য থাকে, বেশির ভাগ সময়ই যাঁরা দ্বিতীয় বিয়ে সমর্থন করেন। ১৯৫৫ সালের গঠিত কমিশনও তাদের প্রতিবেদনে বহুবিবাহের ক্ষেত্রে আদালতকেই সঠিক ফোরাম হিসেবে বিবেচনা করার সুপারিশ করেছিল, তবে তৎকালীন মৌলবাদী ধর্মীয় সমালোচনার চাপে এ সুপারিশ পরিবর্তন করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদকেই শেষমেশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল।

তবে ১৯৬১ সালের পাকিস্তান আমলের সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে আমাদের বর্তমান সামাজিক ও আইনি প্রেক্ষাপট অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। আমাদের বর্তমান আইনে তাই বহুবিবাহের বিধানগুলো নতুন করে পর্যালোচনা করার সুযোগ রয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে যে সালিসি কাউন্সিলের কাঠামো রয়েছে, তার সক্ষমতা ও জবাবদিহি কী করে বাড়ানো যায়, সেদিকেও নজর দেওয়ার প্রয়োজন।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যেহেতু স্বামী যেকোনো সময়ই তালাক দিতে পারেন, নিজের আর সন্তানের সম্ভাব্য আর্থিক দৈন্যের কথা চিন্তা করেও স্বামীর একাধিক বিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হন অনেক স্ত্রী। এ কারণে বহুবিবাহ আইন পরিবর্তনের উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকটি বিষয় দেখাও জরুরি। প্রথমত, বিশ্বের বেশ কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশে স্বামী নির্বিচার বিবাহবিচ্ছেদ করলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্ত্রীকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান রয়েছে, যা ইদ্দতকালীন ভরণপোষণ থেকে আলাদা। শরিয়াহ আইনের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সংগতিপূর্ণ এ রকম বিধান বাংলাদেশের পারিবারিক আইনে প্রয়োগ করা যায় কি না, এটা পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, বৈবাহিক সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার নিশ্চিত করা না গেলে পারিবারিকভাবে নারীর বৈষম্যমূলক অবস্থা পরিবর্তন করা খুবই দুরূহ হবে। এখানেও অন্যান্য দেশের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া যায়, যাতে বিচ্ছেদের পরও একজন নারী যেন নিঃসম্বল না হয়ে পড়েন, বিবাহিত জীবনে তাঁর অংশগ্রহণ যেন আর্থিক মূল্য পায়। তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো, বিবাহবিচ্ছেদের কারণে সহায়-সম্বলহীন নারীকে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা এবং সেবা প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

ধর্মীয় আইনসহ রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রেক্ষাপটেও ন্যায়বিচারই সর্বোচ্চ মানদণ্ড। সেই ন্যায়বিচারের স্বার্থেই বহুবিবাহ-সংক্রান্ত প্রচলিত পারিবারিক আইনের সনাতনী ব্যাখ্যায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। ইসলামে নারীর অবস্থানকে উন্নত করার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। তবে প্রগতিশীল জ্ঞানচর্চার সুযোগ তৈরি করতে না পারলে ধর্মের অপব্যাখ্যাগুলোই আরও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। নারী-পুরুষের সমতা অর্জনে বাংলাদেশের যে যাত্রা, তাতে পরিবারের গণ্ডিতে নারীর সম-অধিকারকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

l তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক

[email protected]