বাঁধভাঙা মানুষের জেদ বনাম পাউবোর কীর্তি

খুলনার কয়রা উপজেলার মঠবাড়ি এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগ বাঁধ রক্ষার চেষ্টা। গত ২৮ মে তারিখে তোলা ছবি
ছবি: সাদ্দাম হোসেন

আড়াই হাজার বছর আগে যখন আকাশে স্যাটেলাইট ছিল না, উটের গ্রীবার মতো উন্নয়নের গর্ব ছিল না, ঢেকুর তোলা মধ্যম আয়ের দেশ ছিল না, সে রকম এক দিনে গুরু শিষ্যকে ডেকে বললেন, ‘বান ডেকেছে, আমার খেতে পানি ঢুকছে। যাও, জমির আল বেঁধে আসো।’ শিষ্য, যার নাম আরুণি, সে পানির তোড়ের মুখে যে মাটিই দেয়, ভেসে যায়। ব্যর্থ হয়ে সেখানে শুয়ে পড়ে শরীর দিয়ে বাঁধ দেয়। এ গল্প মহাভারতের হলেও সত্যি। মহাভারত রচনার আড়াই হাজার বছর পর তার প্রমাণ দিল উপকূলীয় বাংলাদেশ।

নোয়াখালীর হাতিয়ার সোনাদিয়ায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় এ রকম অজস্র গ্রামীণ আরুণিকে দেখা গেল। সারাটা দিন পানির প্রচণ্ড ধাক্কা পিঠ দিয়ে ঠেকিয়ে তাঁরা বাঁধ বাঁচিয়েছেন, গ্রাম বাঁচিয়েছেন। এ চিত্র খুলনার উপকূলীয় ২৭টি উপজেলার অনেক জায়গাতেই দেখা গেছে। দেখা গেছে বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগেও। গত বছর আম্পানের সময়ও মানুষ এভাবে সংগ্রাম করেছে, এবারেও করেছে। খুলনার কয়রায় ইয়াসের ভাঙন মেরামতে গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে ১০ হাজার বস্তা মাটি ফেলেছেন (প্রথম আলো, ২৮ মে ২০২১)। প্রতিবছরই যদি এমন হবে, তাহলে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) আসলে কী করে?

কী করে, তার একটা হিসাব তুলে এনেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়: ঘূর্ণিঝড় আম্পানসহ সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই ১০ বছরে উপকূলীয় ১৬টি জেলায় পাউবোর বরাদ্দ ছিল ১৯ হাজার কোটি টাকা! এই টাকার বেশির ভাগ খরচ হয়েছে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের এলাকায়, যেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে পড়ে খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী।

প্রতিবেদনে পাউবোসংশ্লিষ্ট তথ্যদাতাদের বরাতে আরও বলা হয়, বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হলে উপকূলের ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটার মাটির বাঁধ, ১ হাজার কিলোমিটার জিও ব্যাগনির্মিত বাঁধ এবং ২০০ কিলোমিটার ব্লকনির্মিত বাঁধ সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মাণ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু পাউবো প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬৮টির অধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও অধিকাংশ দুর্যোগসহনশীল অবকাঠামো এখনো নাজুক অবস্থায় আছে এবং ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বাঁধ ভেঙে ১ লাখ ৭৬ হাজার হেক্টর এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এমনকি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রকল্পগুলোও দুর্নীতিতে রেকর্ড করছে।

২০১৫ সালের প্রথম আলোর সংবাদ বলছে, এ প্রকল্পগুলোয় ‘কেউ টাকা মেরে দিয়েছে, কেউ নামকাওয়াস্তে কাজ করেছে, কেউ প্রকল্পের শর্তের বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করেনি। সরকারের জলবায়ু ট্রাস্ট তহবিল (বিসিসিটিএফ) থেকে বরাদ্দ পাওয়া ৫০টি প্রকল্পেরই এমন হাল।’ ২০২০ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি মনে করছে, ঝুঁকি বিবেচনায় জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রকল্প গ্রহণের বেলায় উপকূলীয় এলাকার চেয়ে শহরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বেশি। এই টাকায় এমনকি শহরে ট্রাফিক আইল্যান্ডও বানানো হয়েছে। ৫ বছরের প্রকল্প চলেছে ১০ বছর, যেখানে বিদেশ ভ্রমণের খরচ ছিল ৩৩ কোটি টাকা।

আরও কিছু নমুনা দেওয়া যাক। গত বছর খুলনার কয়রায় বাঁধ সংস্কারের কাজ শেষ না করে প্রকল্পে কর্মকর্তা কর্তৃক অর্থ আত্মসাৎ। আইন লঙ্ঘন করে দরপত্রের শর্ত ও অভিজ্ঞতা পূরণ না হওয়া সত্ত্বেও সংসদ সদস্যের স্ত্রীর প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া। বরগুনা ও পটুয়াখালীতে পোল্ডার নির্মাণ প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্লক ব্যবহারের নামে ঠিকাদার ও প্রকল্প কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অর্থ আত্মসাৎ ইত্যাদি। টিআইবির তথ্য বলছে, বনায়নে সাতটি প্রকল্পের ৬৮ দশমিক ১৬ কোটি টাকার প্রায় ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থই (প্রায় ৩৭.০৭ কোটি টাকা) অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ বা অপচয় করা হয়েছে।

ঝড়-প্লাবনে খুশি হয় মা মাছ আর পাউবোর একশ্রেণির আমলা ও ঠিকাদারেরা। মাছ এ সময় ডিম পাড়ে, আর বাঁধ ব্যবসায়ী ও আমলা-এমপিরা টাকা বানায়। এবারও তারা হয়তো এমন করে বাঁধ বানাবে, যাতে আবার ভাঙে। যাতে আবার কিছু টাকা পানিতে আর কিছু টাকা পকেটে ঢালা যায়। ৯ বছরে ১৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, কিন্তু বাঁধ প্রতিবারই ভেঙেছে। লুটপাটের এ খেলা বাংলাদেশে এখন প্রাকৃতিক নিয়ম। তখনই এই দৃশ্যের জন্ম হয়—কৃষকেরা আরুণি উদ্দালকের মতো বুক-পিঠ দিয়ে পানির ধাক্কা থেকে বাঁধ বাঁচাতে চাইছে।

অবস্থা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবিলা ব্যবস্থার সমস্যা প্রয়োজন সমাধানের জন্য নয়, গোষ্ঠীস্বার্থ মেটানোর জন্য। তাই সমস্যাটা টিকিয়ে রাখা তাদের দরকার। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা ও নদীভাঙনে উপকূল অঞ্চলে ৩ কোটি ৫০ লাখ এবং চরাঞ্চলে ৬৫ লাখ মানুষের মারাত্মক ঝুঁকি এবং মোট জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশের ক্ষতির বিপরীতে শরীর দিয়ে বাঁধ দেওয়ার জেদ ছাড়া আমাদের হাতে তাহলে কী রইল?

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]