বাংলাদেশ কেন উদ্ভাবনের বিরানভূমি?

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ডব্লিউআইপিও এ মাসেউদ্ভাবন সূচক প্রকাশ করে।
ছবি: ডব্লিউআইপিও

আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব সংস্থার ২০১৯ সালের উদ্ভাবন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একবারে তলানিতে। এমনকি নেপালের অবস্থানও আমাদের ওপরে! যদিও বৈশ্বিক বহু সূচকের ব্যাপারে আমরা বরাবরই উদাসীন, তারপরও এসব সূচক অনেক দিক থেকে গুরুত্ববহ। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন আমরা উদ্ভাবনী সূচকে তলানিতে এবং কেনই-বা কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। অনেকেই পুরোনো আইনের দোহাই দিয়ে বিষয়টি হালাল করার চেষ্টা করে বা আশার বাণী শোনান যে ওমুক-তমুক হলে আমরা ভালো অবস্থানে চলে আসব প্রভৃতি। আসলেই কি তা-ই? জ্ঞান-বিজ্ঞানে আমাদের পূর্বসূরিদের অনেক অবদান এখনো জ্বলজ্বল করে, তাহলে এখন কেন এমন? আমাদের বাজেটের আকার এখন যা, আজ থেকে দুই-তিন দশক আগেও তা ছিল অকল্পনীয়। তা সত্ত্বেও আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি কেন নিম্নমুখী, আমরা কি তাহলে উদ্ভাবনের বিরানভূমিতে পরিণত হচ্ছি?

পেশাগত কারণে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাঝেমধ্যেই যেতে হয়। এ পর্যন্ত যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি, সব জায়গায় বাংলাদেশিদের জয়জয়কার—সেটা শিক্ষকতা, গবেষণা বা অন্য কিছু হোক। এই বাঙালিরাই দেশে কেন সফল হচ্ছেন না? অনেকের সঙ্গে কথা বলে মোটাদাগে একটা বিষয় পরিষ্কার। এটা যেন সেই অর্থনীতির অত্যন্ত পরিচিত তত্ত্ব ‘খারাপ মুদ্রা ভালো মুদ্রাকে বাজার থেকে সরিয়ে দেওয়ার’ তত্ত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ, দুষ্টচক্র উৎকৃষ্টকে ছুড়ে ফেলছে, ম্লান করে দিচ্ছে সবকিছু, বাধা দিচ্ছে উদ্ভাবনী মেধার বিকাশে।

পিএইচডি করার সময় আমার তত্ত্বাবধায়ক প্রায়ই জাপানের বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রধানতম হওয়ার গল্প বলতেন । গর্ব করতেন অর্থনীতি আর জ্ঞানবিজ্ঞানে জাপানের আধিপত্য নিয়ে। শোনাতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানিদের দেশের প্রতি আত্মত্যাগ, কাজে একাগ্রতা এবং সততার কথা। সব সময় জোর দিয়ে বলতেন, জাপান সব ক্ষেত্রে এমন একটা সিস্টেম (পদ্ধতি) তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত চলবে। উচ্চশিক্ষা শেষে ২০০৫ সালে দেশে ফেরার সময় উপদেশ হিসেবে বলেছিলেন, ‘পরিকল্পনা করো এখন থেকে পাঁচ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চাও’; বলেছিলেন, ‘মনে রেখো, দেশের কল্যাণ সর্বাগ্রে।’ এখন পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়কের কথা মানার চেষ্টা করি। জাপানি শিক্ষকদের মতো অবস্থা আমাদের সমাজেও একসময় ছিল, কিন্তু কালের বিবর্তনে তাঁদের সংখ্যা দ্রুত কমছে, পাল্লা দিয়ে সব ক্ষেত্রে বাড়ছে ‘অ-উদ্ভাবনী’, ‘চাটুকার’ আর ‘অযোগ্যদের’ বহর।

যেকোনো দেশে সাধারণত উদ্ভাবনী কাজের দায়িত্বে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও সরকারি-বেসরকারি গবেষণা সংস্থা। বর্তমানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৫৩; সরকারি ৪৬টি আর বাকিগুলো বেসরকারি। রয়েছে ১৬ বা ১৭টি সরকারি গবেষণা সংস্থা। স্বায়ত্তশাসিত গবেষণাকেন্দ্রগুলো ধরলে এই সংখ্যা ৩০ বা ততোধিক। এমতাবস্থায় আমাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা কমবে কেন? উল্টো হওয়া কি অযৌক্তিক? ওই সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেকোনো দেশের উদ্ভাবনের গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি। আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে তো বিশ্বের রোল মডেল বলা হচ্ছে, তাহলে উদ্ভাবনী সূচকে কেন তলানিতে?

যদি কেউ বলেন, আমাদের সক্ষমতার অভাব, কথাটা মোটেই ঠিক না। আমরা অবশ্যই সক্ষম। তার প্রমাণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেকই রয়েছেন। সমস্যা আসলে অন্য জায়গায়। বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়সহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজের পরিবেশ দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে বহুবিধ কারণে। হবেই না কেন? আমরা সবকিছুকে যে ‘রাজনৈতিকীকরণ’ করে ফেলেছি! কম্পিউটার বিজ্ঞানে একটা মৌলিক প্রবাদ হচ্ছে, ‘জঞ্জালের আউটপুট জঞ্জাল’ অর্থাৎ, গুণগত উপাত্ত প্রবিষ্ট না হলে উৎপাদিত ফলও হবে জঞ্জাল। মানে দাঁড়াচ্ছে, আমরা মূল সমস্যা অনুধাবন করছি না বা করতে আগ্রহী নই। শুধু নিত্যনতুন প্রতিষ্ঠান আর বিভাগ খুলতে বেশি আগ্রহী, যা সময়ের সঙ্গে খুবই বেমানান।

আমরাই মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র জাতি, যারা অনেক কিছুতে ব্যাকরণ মানতে অনিচ্ছুক, শুধু নিজেরটাই বুঝি, দেশের স্বার্থরক্ষা হলো কি না, তাতে কি যায়-আসে! মনে রাখা দরকার, একটা সড়ক দুর্ঘটনা যেমন কোনো একটা সংসারের সারা জীবনের কান্না, তেমনি একটি ‘মেধাহীন’ নিয়োগ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের ৩০-৪০ বছরের বোঝা। এই ‘মেধাহীনেরা’ শুধু যে জঞ্জাল তা নয়, তারা আবার সমমনাদের সাথি করে দুষ্টুচক্রকে করে শক্তিশালী, ফলে মেধাবীরা হয়ে পড়ে কোণঠাসা, পিছিয়ে পড়ে মুক্তচিন্তায়। উদ্ভাবনী শক্তি হয় বিনষ্ট, কিন্তু সর্বনাশ তো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির।

ওই উদ্ভাবনী সূচকে এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর প্রথম। না হওয়ার কি কোনো কারণ আছে। ১৯৬৫ সালে দেশটি স্বাধীনতা পাওয়ার পর আজকে যে অবস্থানে এসেছে, তার কারণ ছিল প্রধানত তিনটি: ১. দেশের যেকোনো কিছুতে মেধাবী ও অধিকতর যোগ্যদের অন্তর্ভুক্তকরণ, ২. পাবলিক নীতিনির্ধারণে/দেশের স্বার্থে যা কিছু ভালো তা পরিগ্রহণ এবং ৩. সব ক্ষেত্রে অবশ্যপালনীয় সততা। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কি এই তিনটি বিষয় পরিগ্রহণ করতে পেরেছি? জনগণের করের টাকার জবাবদিহি ও সুষ্ঠু ব্যবহার কি নিশ্চিত করতে পেরেছি? শোনা যাচ্ছে, উচ্চশিক্ষার/গবেষণার মান নিশ্চিতে আসছে অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল। এই সংস্থা কি পারবে উদ্ভাবনী গবেষক তৈরি করতে? পারবে কি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিরাজনীতিকরণ করে সুন্দর কাজের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে? নাকি বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই নখদন্তহীন বাঘের মতো হুংকারসর্বস্ব হয়ে থাকবে? ভাবী প্রতিষ্ঠান কি পারবে রাজনীতিমুক্ত থাকতে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোধ করি সবকিছু পরিষ্কার হবে।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, অর্থই অনর্থের মূল। আমাদের দেশে যেভাবে আফজাল, পাপিয়া, মালেক, সম্রাট আর সাহেদদের উত্থান বাড়ছে, তাতে মনে হয় আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি শুধু অর্থ আর সম্পদ বানানোর নিমিত্তেই; জ্ঞান তৈরি, নতুন উদ্ভাবন বা দেশের কল্যাণের জন্য নয়। আমরা এই অঢেল অর্থ দিয়ে কী করব যদি সুশিক্ষিত, সৎ আর কর্মদক্ষ মানবসম্পদ না থাকে। দেশের নীতিনির্ধারকেরা অনুগ্রহ করে ভেবে দেখবেন কি? নাকি ‘অস্বাভাবিকতা’ নিয়মে পরিণত হবে, যা দেশ আর জনগণের দীর্ঘ মেয়াদে কুফল ছাড়া সুফল দেবে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

ড. আশরাফ দেওয়ান: স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া।