বাংলাদেশে করোনা টিকা উৎপাদন সময়ের দাবি

করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব এক ভয়াবহ সময় অতিবাহিত করছে। সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও অত্যন্ত উদ্বেগজনক হয়ে পড়েছে। উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত—কোনো দেশই এর থেকে ছাড় পাচ্ছে না। এই সংক্রমণ থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যেমন প্রয়োজন, তেমনই এর প্রতিরোধের জন্য টিকা গ্রহণও অত্যাবশ্যকীয়। তাই বিশ্বের অনেকগুলো দেশ টিকা উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যার মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশ সফলতা পেয়েছে। কিন্তু টিকার সুফল পেতে হলে বিশ্বের প্রায় সব মানুষকেই টিকা গ্রহণের আওতায় আনতে হবে।

এই মুহূর্তে যে পরিমাণ টিকা দরকার, উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো তা উৎপাদন করে কুলাতে পারছে না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ চুক্তি থাকা এবং অগ্রিম অর্থ প্রদানের পরও পরিমাণমতো টিকা পাচ্ছে না। তাই সব মিলিয়ে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের বিষয়টি সময়ের দাবি হিসেবে সামনে চলে এসেছে।

গত ২৪ এপ্রিল ২০২১ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় সাংবাদিক শিশির মোড়লের লেখা ‘জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট-টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা বাংলাদেশেই ছিল, টিকার চাহিদা এখন বিশ্বব্যাপী-দেশেই টিকা উৎপাদনের জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার’—শিরোনামে একটা প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। বাস্তবসম্মত, তথ্যবহুল এবং খুব গোছানো একটা লেখা।

লেখাটিতে অনেক দিন পর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সম্পর্কে অনেক ভালো কথা বলা হয়েছে। আমি এই ইনস্টিটিউটের ডিপিটি শাখার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে অনেক বছর কাজ করেছি। তাই ইনস্টিটিউটের অনেক কিছু আমার চোখে ভেসে উঠল। উল্লেখ্য, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবচেয়ে পুরোনো একটা স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, যার কর্মপরিধি এককথায় বিশাল। এই ইনস্টিটিউটে একসময় অনেকগুলো টিকা উৎপাদন হতো। যেমন: গুটিবসন্ত, কলেরা, টাইফয়েড, জলাতঙ্ক, ধনুষ্টঙ্কার, ডিফথেরিয়া ইত্যাদি। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে নানা জটিলতার কারণে টিকা উৎপাদন একসময় বন্ধ হয়ে যায়। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদন ল্যাবরেটরিতে যেসব সুযোগ-সুবিধা বা পরিবর্তন দরকার তা করে উঠতে না পারায় ঐতিহ্যবাহী এই ইনস্টিটিউট টিকা উৎপাদনে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে করে টিটেনাস বা ধনুষ্টঙ্কার নির্মূলের উদ্যোগও ব্যাহত হয়। তবে সরকার টিকা কার্যক্রম সচল রাখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি।

সেই চেষ্টার ধারাবাহিকতায় ১৯৯১-৯২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় আমরা একদল বিজ্ঞানী নতুন করে আবার টিটেনাস টক্সয়েড (টিটি) উৎপাদনের কাজে যোগ দিই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শদাতার উপস্থিতিতে আমরা আংশিক সংস্কারকৃত পুরোনো ল্যাবরেটরিতে নতুন করে টিটি টিকা উৎপাদনের কাজ শুরু করি। ওয়ার্ক প্ল্যান অনুযায়ী, ১৯৯২ সালের মাঝামাঝি ৫টি ব্যাচের টিকা গুণগত মান পরীক্ষার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান কার্যালয়, জেনেভাতে পাঠানো হয় এবং ফিনল্যান্ডের টিকা ল্যাবে তা পরীক্ষা করা হয়। ফলাফলে দেখা যায় সব কটি ব্যাচের টিকার গুণগত মান কাট-অফ মাত্রার অনেক ওপরে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা দল আমাদের ল্যাব পরিদর্শনে আসে। তারা উৎপাদনের বিভিন্ন কার্যক্রম খতিয়ে দেখে এবং উৎপাদিত টিকা ইপিআইতে সরবরাহ করার সম্মতি দেয়। তবে এর সঙ্গে তারা একটা শর্ত জুড়ে দেয়। তা হলো যেকোনো দুটি ব্যাচের টিকা ব্যবহার করে মানবদেহে টিকার প্রতিরোধক সক্ষমতা পরীক্ষা করা। এই পরীক্ষায় সফলতা পাওয়ার পরই ইপিআইতে সরবরাহ করা যাবে। ইউনিসেফ ও ইপিআইয়ের সহযোগিতায় সেটা করা হয় এবং ফলাফলে আবারও প্রমাণিত হয় আমাদের টিকা অনেক বেশি গুণগত মানসম্পন্ন।

কিন্তু এটাই শেষ নয়, আবারও নতুন শর্ত আসে, ইপিআইতে সরবরাহের আগে প্রতিটি ব্যাচই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে পরীক্ষা করাতে হবে। কিন্তু কোনো শর্তই আমাদের উদ্যমী বিজ্ঞানীদের দমাতে পারেনি। তখন আমরা ধারাবাহিকভাবে ২৫টি ব্যাচের নমুনা জেনেভাতে পাঠাতে শুরু করি। প্রতিটি ব্যাচই প্রমাণ করে আমাদের টিকা সবদিক দিয়েই অত্যন্ত মান সম্পন্ন।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আমাদের নিবেদিত কাজ ও উদ্যোগ কোনোটিই এই টিকা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে পারেনি। আমরা সবাই মিলে যখন শুরু করেছিলাম যন্ত্রপাতিগুলো ছিল অনেক পুরোনো। আশা ছিল এগুলো দিয়ে কাজ করতে পারলে আধুনিক যন্ত্রপাতি পাব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। তদুপরি টিকার ল্যাব, জনবলের সমস্যা, টিকা রাখার জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার কোল্ড রুমের তাপমাত্রা ঠিক না থাকা ইত্যাদি নৈমিত্তিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

টিকার কাজের প্রশাসনিক কাঠামো হতে হয় গতানুগতিক থেকে অনেক আলাদা। সে জন্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটা দল বারবার এসেছে, জিজ্ঞাসা করেছে এবং চেষ্টা করেছে আমাদের সহযোগিতা করতে। কিন্তু একসময় তারাও আর উৎসাহ বোধ করেনি। যার ফলে ক্রমেই টিকার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং স্তিমিত হয়ে যায় আমাদের প্রাণবন্ত জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সেই প্রিয় ল্যাবরেটরিটি।

যাহোক, কয়েক বছর ধরে একটা ভালো উদ্যোগ দেখছি—বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে টিকা উৎপাদন নিয়ে কথা হচ্ছে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অল্প দিনের মধ্যেই আমরা গ্যাভি এলিজিবল থাকব না। তখন নিজেদের টিকা নিজেদেরই ক্রয় করতে হবে এবং বিদেশ থেকে অনেক টাকা দিয়ে টিকা কিনে আনতে হবে। বর্তমানে সবাই টিকা প্রায় বিনা পয়সায় পাচ্ছি। সুতরাং এখনই আমাদের টিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হবে।
প্রাইভেট সেক্টরে টিকা তৈরি হলে সেটা স্বাভাবিকভাবেই একটু ব্যয়বহুল হবে। সে ক্ষেত্রে সরকারি ল্যাবরেটরিতে টিকা বানানোর উদ্যোগ থাকতে হবে। যেমন নিউমোনিয়া, পেন্টা ভ্যালেন্ট, টাইফয়েড, রোটা ইত্যাদি। প্রাথমিকভাবে পুরোনো টিকা, যা কিনা অনেক দেশেই তৈরি হচ্ছে (যেমন বিসিজি, হেপি বি ইত্যাদি), সেগুলো দিয়েই আমরা শুরু করতে পারি।

এই সময়ে মহামারিটা আমাদের অনেক কিছুই মনে করিয়ে দিচ্ছে। শেখাচ্ছে যে আমাদের নিজেদের জন্য সক্ষমতা কতটা প্রয়োজন। আমরা বেশির ভাগ সময়ই কাজ করতে বিদেশিদের ওপর নির্ভর করি। আর এখন বিদেশিরাই ব্যস্ত তাদের নিজেদের কাজ নিয়ে। আমাদের কাজটা এখন তারা কেউ দেখে না। তাই এখন বারবার শুধু মনে হচ্ছে আমরা নিজেরাই কেন এই কাজগুলো করতে পারব না।
প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান যদি সত্যিকারেই টিকা উৎপাদনের কাজ শুরু করে, সে ক্ষেত্রে সরকারকেও উৎপাদনে এগিয়ে আসাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এতে ক্রমেই ১৮ কোটি মানুষের দেশ টিকায় স্বনির্ভর হয়ে উঠবে।

তাই সবশেষে বলতে চাই প্রাইভেট সেক্টরে টিকা উৎপাদন এবং একই সময়ে জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে অথবা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে টিকা উৎপাদন অত্যন্ত প্রয়োজন। এতে দুই প্রতিষ্ঠানের টিকার মূল্যে সামঞ্জস্য থাকবে। উৎপাদনে যে যে সুবিধাদি একান্তই দরকার, তার দিকে সরকারকে অনেক বেশি খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে যেন আবার না হতে হয়।

আমরা কাজ করার সময় আমাদের/সরকারকে যে কারণে ব্যর্থ হতে হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতার আলোকে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা হলো।
১. টিকা উৎপাদনের জন্য সব ধরনের সুবিধাদিসহ ল্যাব তৈরি করা।
২. উৎপাদনের সব পর্যায়েই প্রশিক্ষিত লোকবল থাকা। যে যে ক্ষেত্রে কাজ করবে তাকে সেই বিষয়ের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া।
৩. কোনো পর্যায়ের জনবলকে অন্য কোথাও বদলির কোনো সুযোগ না থাকা।
৪. স্পেসিফিক কাজের জন্য সেই ফিল্ডের বাইরের অন্য কোনো ব্যক্তিকে যোগদান না দেওয়া।
৫. ল্যাব সুপারভিশনের জন্য যাঁরা থাকবেন, তাঁদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া।
৬. যন্ত্রপাতি খুবই স্পেসিফিক হওয়া, যেখানে ক্যাপাসিটি অনুযায়ী একটার সঙ্গে আরেকটা যন্ত্রের সামঞ্জস্য থাকা।
৭. সংরক্ষণ ও মেরামতের জন্য নিজস্ব ওয়ার্কশপ থাকা।
৮. যন্ত্রপাতি সরবরাহ নেওয়ার আগেই মেশিনের সংরক্ষণের জন্য বিস্তারিত চুক্তি করা।
৯. সব সুবিধাদিসহ অ্যানিমেল হাউস থাকা এবং সে জন্য আলাদা লোক নিয়োগ দেওয়া।

আমার বিশ্বাস সব বিষয়গুলো ঠিক রেখে কাজ করলে বাংলাদেশ নতুন করে টিকা উৎপাদনে সফলতা পাবে।

ড. সেতারুননাহার ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক