২৭ সেপ্টেম্বর ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার আহ্বানে ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে টুরিজম অ্যান্ড ওয়াটার-প্রোটেকটিং আওয়ার কমন ফিউচার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং যথার্থ প্রতিপাদ্য। পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ এবং হাজার নদীর দেশ নদীমাতৃক আমাদের বাংলাদেশই তো হবে নদীকেন্দ্রিক পর্যটনের তীর্থভূমি—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু বাস্তব চিত্রটি একেবারেই উল্টো।
যে শিল্পটি ২০১২ সালে বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটির ওপর পর্যটককে ধারণ করেছে, যে শিল্পের এককভাবে জিডিপিতে ৯ শতাংশ অংশীদার, যে শিল্প বিশ্ববাণিজ্যের ৬ শতাংশ ধারণ করে কিংবা এক বছরে রপ্তানিতে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে, সে শিল্পটি বাংলাদেশে বড়ই অবহেলিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দুটি দেশ পাকিস্তান, মিয়ানমারে ২০১২ সালে এক মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করলেও আমাদের অবস্থান সে তুলনায় অনেক নিচে।
২০১০ সালে বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড (বিটিবি) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বেসরকারি সংস্থাগুলো অনেক আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কারণ, টুরিজম বোর্ড হলো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গড়া একটি সংস্থা। ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলোর কণ্ঠস্বর ওখানে শোনা যাবে, এটাই কাম্য ছিল। কিন্তু আমরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, ওখানেও বেসরকারি পর্যায়ে যাঁরা নিয়োগ পেলেন, তাঁদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া হলো। তা না হলে একজন সিনেমার পরিচালক কী করে বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডের সদস্য হলেন, তা আমাদের বোধগম্য নয়। ফলে বেসরকারি কণ্ঠস্বর স্তিমিতই থেকে গেল। প্রতিষ্ঠার পর সরকার বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ডকে প্রথম বছরে প্রায় ৬৬ কোটি টাকা মার্কেটিং ও প্রমোশনাল কাজে দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ওখান থেকে প্রায় অর্ধেকেরও বেশি টাকা খরচ না করতে পেরে টুরিজম বোর্ড পরবর্তী সময়ে সরকারি কোষাগারে ফেরত দেয়।
কেন সরকার বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড প্রতিষ্ঠা করল এবং বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এর কী ভূমিকা, তা বোধ করি নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। প্রতিষ্ঠার পর গত তিন বছরে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের প্রসারে টুরিজম বোর্ড কী অবদান রেখেছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। একমাত্র নিয়মিতভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যটন মেলায় অংশগ্রহণ করা ছাড়া টুরিজম বোর্ডের আর কোনো দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড আমাদের নজরে পড়েনি। এই অংশগ্রহণ নিয়েও আবার কথা আছে। বিভিন্ন সময়ে মেলায় সরকারি যে প্রতিনিধিদল অংশ নেয়, তাদের যোগ্যতা, দক্ষতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়েও যথেষ্ট প্রশ্ন তোলা যায়। কাঠের পুতুলের মতো স্টলে দাঁড়িয়ে থাকা আর শপিং করা ছাড়া তাঁদের আর পর্যটনসংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডে তেমন পাওয়া যায় না। অথচ এঁদের একেকজনের পেছনে সরকারের ব্যয় হয় লাখ লাখ টাকা।
এভাবেই এগোচ্ছে বাংলাদেশের পর্যটন খাত। কিন্তু কোন লক্ষ্যে এগোচ্ছে, কোথায় যেতে চায়, সেখানে পৌঁছার জন্য কোনো মিশন, ভিশন কিংবা অবজেকটিভ আছে কি না, তা না জেনেই এক অজানা লক্ষ্যে এগোচ্ছে বাংলাদেশের বিকাশমান পর্যটন খাত। যেটিকে সম্প্রতি এফবিসিসিআই আয়োজিত এক সেমিনারে তৈরি পোশাক সেক্টরের পর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় শিল্প খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে সবাই। কিন্তু এটুকুই। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প তাই এখন পর্যন্ত ওই সেমিনার, সিম্পোজিয়াম আর আলোচনার টেবিলেই সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত জুলাই থেকে টুর অপারেটরদের ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় নিয়ে এসেছে, অর্থাৎ এখন থেকে ইনবাউন্ড ও আউটবাউন্ড যে পর্যটনই করা হোক না কেন, সরকারি কোষাগারে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে, যেটি বিগত বছরগুলোতে ছিল না। কী আশ্চর্য বৈপরীত্য! একদিকে টুর অপারেটরগুলোকে পর্যটনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ট্যাক্স ফ্রি কিংবা কোনো প্রণোদনার ব্যবস্থা না করেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ১৫ শতাংশ ভ্যাটের আওতায় নিয়ে গেল। অথচ বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে শুনিনি। আর এরই মধ্যে বিশ্ব পর্যটন দিবসে পর্যটনশিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা টুর অপারেটরদের সহযোগিতা করার আশ্বাস-সংবলিত বাণী সবার মুখে মুখে।
দেশের টুর অপারেটররা আর এই বাণী শুনতে চায় না। যদি প্রকৃতই সরকার এ দেশে পর্যটনশিল্পের যথাযথ উন্নয়ন ও অগ্রগতি চায়, তাহলে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে, এ মুহূর্তেই ওই ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারসহ টুর অপারেটরদের প্রয়োজনীয় যানবাহন ট্যাক্স ফ্রিতে কেনা এবং যথাযথ প্রণোদনা দিতে হবে। আর এতে করে বেসরকারি সংস্থাগুলো আরও বেশি উৎসাহিত হবে এবং দেশে বিদেশি পর্যটক এনে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত আরও একটু স্ফীত করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করবে। বিশ্ব পর্যটন দিবসে এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।
তৌফিক রহমান: পরিচালক, টুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)।
[email protected]