বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে

আঁকা: তুলি
আঁকা: তুলি

সংবিধান অনুযায়ী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে—প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার জবাবে বিরোধী দল বলেছে, সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। এই প্রেক্ষাপটে চলমান রাজনীতি নিয়ে দুই বিশেষজ্ঞের মত প্রকাশ করা হলো।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে জানিয়েছেন, ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী এটা করতে পারেন। নির্বাচন কখন হবে না-হবে, তা তিনি নির্ধারণ করতে পারেন। তিনি এর আগে যা বলেছেন, এবারও তিনি তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। সেটা হলো, পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র যেখানে রয়েছে সেখানে যেভাবে নির্বাচন হয়, তেমনি বাংলাদেশেও হবে। তবে আমি মনে করি না যে সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। কারণ, গণতন্ত্রে সমঝোতার পথ রুদ্ধ হওয়ার নয়। দলীয় সরকারের যিনি প্রধান থাকেন, তিনিই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর একটি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা থাকে। মন্ত্রিসভা নীতিনির্ধারণী কোনো ভূমিকা পালন করে না। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করে। প্রধানমন্ত্রী এ কথাও স্পষ্ট করেছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই এবং তিনি এ বিষয়ে তাঁর অবস্থানে অনড় আছেন। যদিও আমাদের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং অন্যান্য দল দাবি করে আসছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে তাদের দাবি পূরণের কোনো ইঙ্গিত নেই। আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হবে, তা নিশ্চিত। বিরোধী দলের এখন দুটি পথ খোলা আছে। একটি হচ্ছে নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের পথে যাওয়া এবং তাদের দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করা। আরেকটি পথ হচ্ছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণে আমার মনে হয়, শেষ পর্যন্ত প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ২৪ জানুয়ারির মধ্যেই অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। এর পেছনে যুক্তি হলো, আমাদের হাতে চার মাস সময় আছে। এর মধ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলা বাস্তবসম্মত কি না। বিগত দিনের অভিজ্ঞতার আলোকে যদি দেখি, জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন আন্দোলন হয়েছে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯৪ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করেছে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দল। সেটা প্রায় তিন বছরের মাথায় গিয়ে জনতার মঞ্চ ইত্যাদি করার মধ্য দিয়ে তা সফল হয়েছে।

কিন্তু বর্তমান বিরোধী দল সেই রকমের কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি। দ্বিতীয়ত সব সময় কি আন্দোলন রচনা করা যায়? রাস্তায় আন্দোলন করা, মারমুখী হওয়া এবং জীবনের ঝুঁকি নেওয়া ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন দিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে জনগণের মধ্যে সমর্থন থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রবর্তনে জনগণ রাস্তায় নেমে আসবে, মারমুখী হবে এবং জীবনের ঝুঁকি নেবে, তা মনে হয় না। এর মূল কারণ হলো যেকোনো একটা প্রস্তাবের পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তুলতে হবে। তার একটি বাস্তব পরিস্থিতি লাগে। বর্তমান সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার সংস্থা ও উপনির্বাচনসহ বিভিন্ন স্তরে সাড়ে পাঁচ হাজার নির্বাচন হয়েছে। সবশেষ পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হলো। প্রধান বিরোধী দল তাতে ভালো করেছে। গাজীপুর ছিল আওয়ামী লীগের জন্য নিরাপদ, অথচ সেখানে এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে তারা হেরে গেছে। আসলে বিগত দুই দশকের বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। কাজেই আশি ও নব্বই দশকের শুরুতে যে মনমানসিকতা, তা দিয়ে ২০১৩ সালের পরিস্থিতি যদি বিবেচনা করতে চাই, তাহলে সেটা মারাত্মক ভুল হবে।
আজকে আমাদের যে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, সেসব যেভাবে সোচ্চার ও সচেতন, উপরন্তু রয়েছে নির্বাচনী পর্যবেক্ষক, রয়েছে নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও যে তীক্ষ দৃষ্টি রয়েছে, তা জাতিসংঘের মহাসচিবের টেলিফোনের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশের ঘটনায় উদ্বেগ অনুভব করছে। এ রকমের একটি পরিবেশে আশি ও নব্বই দশকে যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেভাবে নির্বাচন এখন আর কেউ ভাবতে পারে না। সে ধরনের নির্বাচন বাংলাদেশে আর কখনো অনুষ্ঠিত হবে না।
যেহেতু প্রধান বিরোধী দলের সামনে এখন বিকল্প হলো নির্বাচনমুখী আন্দোলন। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। গণতন্ত্র চর্চা করতে তারাও চায়। জনগণের ভোট নিয়ে একাধিকবার তারা ক্ষমতায় এসেছে। অতএব এ কথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে, নির্বাচনী পরিবেশ-পরিস্থিতি তাদের জন্যই অনুকূল রয়েছে। অন্তত পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ফলাফল সেটাই প্রমাণ করে। অন্যদিকে সরকারি দল মনে করে, গত পৌনে পাঁচ বছরে তারা যত উন্নয়ন করেছে, তাতে জনগণ তাদেরও ম্যান্ডেট দিতে পারে। তাই উভয় পক্ষের জন্য যেখানে উইন উইন পরিস্থিতি, সেখানে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিএনপির নেতারা দেখতে পাচ্ছেন, তাঁদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবার আন্দোলন করে দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার সম্ভাবনা তেমন নেই, সেখানে তাদের বিকল্প বেছে নেওয়াই হবে শ্রেয়। তাই, আমার মনে হয় না বিএনপি বর্জনের দিকে যাবে। কারণ, তাতে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আরও বেশি অনিশ্চিত হবে। এখন বিরোধী দল হয়তো একটা আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে, গণসংযোগ করবে, দেশব্যাপী কর্মসূচি নেবে। তারা আন্দোলনকে নির্বাচনের অংশ হিসেবে দেখবে। আন্দোলনের একপর্যায়ে চূড়ান্তভাবে তারা হয়তো নির্বাচনের পক্ষেই সিদ্ধান্ত নেবে। বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করলে আমার কাছে এটাই প্রতীয়মান হয়।
শেষ কথা হলো, তত্ত্বাবধায়ক হোক আর না হোক, জনগণের ব্যালটের ফলাফল পাল্টে দেওয়ার দিন বাংলাদেশে শেষ হয়ে গেছে।
অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ, উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।