বিএনপির গণতন্ত্রচর্চা এবং যত দোষ নন্দ ঘোষ

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী
ছবি: প্রথম আলো

মানুষ ক্রুদ্ধ হলে যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সেটি আবারও প্রমাণ করলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি দলীয় অফিসে সংবাদ সম্মেলন করেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম সম্পর্কে। একজন সম্পাদকের একটি লেখা নিয়ে কোনো দলের সংবাদ সম্মেলনের ঘটনা বিরল।

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। সেই নিবন্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গণতন্ত্র ফুলেফেঁপে উঠেছে এবং বিএনপির আমলে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এ রকম ঢালাও মন্তব্য করেননি মাহ্ফুজ আনাম। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল After 30 years of autocracy’s demise, democracy still remains a distant dream. অর্থাৎ স্বৈরাচারের পতনের ৩০ বছর পর এখনো গণতন্ত্র দূরের স্বপ্ন।

এ কথার মধ্যে রিজভী সাহেব আওয়ামী লীগের পক্ষে দালালি এবং বিএনপির প্রতি বিষোদ্গার কোথায় পেলেন? রিজভী বলেছেন, মাহ্‌ফুজ আনাম সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অপ্রাসঙ্গিক মতামত দিয়েছেন। তাঁর দাবি, মাহ্‌ফুজ আনাম যা করেছেন, তা হলুদ সাংবাদিকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য অপরাধ। তিনি মাহ্‌ফুজ আনামের রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজের পক্ষে যুক্তি খাড়া করতে তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জেলায় জেলায় মামলা দায়েরের ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন।

রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই মেরুতে অবস্থান করে। কেউ কারও মুখ দেখতে নারাজ। কিন্তু ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে আঘাত লাগলে তাঁরা এক হতেও দ্বিধা করেন না। একে অপরকে সাক্ষী মানেন।

মাহ্‌ফুজ আনামের প্রবন্ধটি দুবার পড়লাম। রুহুল কবির রিজভী যেসব অভিযোগ করেছেন, তাতে বাগাড়ম্বর ও গালাগালি থাকলেও সত্যতা নেই। মাহ্‌ফুজ আনাম লিখেছেন, স্বৈরাচারের পতনের পর যে গণতান্ত্রিক ধারা সূচিত হয়েছিল, সেটি বারবার ব্যাহত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের সবকিছু দখল করা এবং বিরোধী দলের সংসদ বর্জন ও পদত্যাগের মতো আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডের কারণে। কোনো দলই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা দেয়নি। রিজভীর ভাষায় এক–এগারোর অসাংবিধানিক সরকারই নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করে। যদিও নানা কৌশলে বিচার বিভাগের ওপর দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান হস্তক্ষেপ এখনো চলছে।

রিজভীর এই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কারণ মাহ্‌ফুজ আনামের ওই প্রবন্ধ নয়। এর আগে তিনি সামরিক শাসন নিয়ে আরেকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন এবং তাতে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কঠোর সমালোচনা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য সমর্থন করে তিনিও লিখেছেন, সেনাবাহিনীর অভিধান থেকে সামরিক আইন বা মার্শাল ল শব্দটি চিরতরে মুছে ফেলা উচিত। মাহ্‌ফুজ আনামের মতে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও সেনাবাহিনী একাধিকবার ক্ষমতা দখল করেছে। আর এই দখল প্রক্রিয়ায় জিয়াউর রহমানও ছিলেন। বিএনপির নেতার ক্ষুব্ধ হওয়ার মূল কারণ এটাই।

জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ভূমিকার জন্য স্বাধীনতা–পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছিল এসব সত্য। তাঁর ব্যক্তিগত সততা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। কিন্তু জিয়া যে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক দল গঠন এবং ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে প্রহসনমূলক গণভোট করেছিলেন, সে কথা অস্বীকার করা যাবে না। আমরা যদি সামরিক শাসনের বিরোধিতা করি, তাহলে জিয়া ও এরশাদের শাসনের সমালোচনা করতেই হবে। এখানে কাউকে ভিলেন ও কাউকে হিরো বানানোর সুযোগ নেই। মাহ্‌ফুজ আনাম দুই সেনা শাসকেরই সমালোচনা করেছেন। সামরিক শাসন যে কোনো দেশে সুফল বয়ে আনে না, তা বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। এতে রিজভী সাহেবের আঁতে ঘা লেগেছে।

বিএনপির নেতার দাবি, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্পর্কে ডেইলি স্টার সম্পাদক মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অপ্রাসঙ্গিক মতামত দিয়েছেন। মতামত বিএনপির পক্ষে হলে ঠিক আছে, বিপক্ষে গেলেই যত সমস্যা।

এখন দেখা যাক, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা নিয়ে মাহ্‌ফুজ আনাম আসলে কী বলেছেন। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার সরকার এ ঘটনার যথাযথ তদন্ত করেনি। বিচার করেনি। তারা তদন্তের নামে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজিয়েছে। এখানে মাহ্‌ফুজ আনাম মিথ্যাচার কোথায় করলেন? বিএনপি সরকার কি জজ মিয়া নাটক সাজায়নি? তারা কি ওই গরিব ছেলেটির কাছ থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেনি? সত্য উদ্‌ঘাটন না করে উল্টো এ ঘটনার দায় আওয়ামী লীগের ওপর চাপানোর চেষ্টা করেছে বিএনপি।

রিজভী বলেছেন, তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকার জন্য গ্রেনেড হামলা করতে যাবেন কেন? মাহ্‌ফুজ আনাম কোথাও বলেননি খালেদা জিয়া ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটিয়েছেন। কিন্তু হামলাকারীদের রক্ষা করতে তৎকালীন বিএনপি সরকারের অনেকে যে সহায়তা করেছেন, সেটি প্রমাণিত। রুহুল কবির রিজভী ২১ আগস্টের তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন ও এফবিআইকে নিয়ে আসার কৃতিত্ব দাবি করেছেন। এফবিআই প্রতিনিধিরা দেশে ফেরার সময় বলেছিলেন, তদন্ত অসমাপ্ত, আরও তদন্ত প্রয়োজন। সেই আরও তদন্ত আর বিএনপি সরকার করেনি। তারা বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে যে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় কমিশন করেছিল, তার উদ্‌ঘাটন ছিল হাস্যকর। যেখানে দেশবাসী দেখেছে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের একাংশের পৃষ্ঠপোষকতায় হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিরা এ ঘৃণ্য হামলা চালিয়ে ২২ জন মানুষকে হত্যা করেছে, সেখানে বিচার বিভাগীয় কমিশন আবিষ্কার করলেন পার্শ্ববর্তী দেশের গোয়েন্দা সংস্থা ভাড়াটে লোক দিয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগেই ‘জজ মিয়া’ রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়। তাহলে কার বক্তব্য মিথ্যাচার, সে কথা দেশবাসীই বিচার করবেন।

রিজভী সাহেব আরও যেসব কথা বলেছেন, তা নিজেদের অপকর্ম ঢাকার ব্যর্থ প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়। তাঁর দাবি, ২০০৮ সালে পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এবং তাতে মাহ্‌ফুজ আনামও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। মাহ্‌ফুজ আনাম যদি ষড়যন্ত্র করেই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবেন, তাহলে এই সরকারের আমলে তাঁর বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ৮৩টি মামলা হলো কেন? কথায় কথায় ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ডেইলি স্টার নিয়ে বিষোদ্গারই–বা কেন করবেন?

বিএনপি বা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অনেক অমিল থাকলেও একটি মিল আছে। নির্বাচনে হারলেই তারা সংবাদমাধ্যমের ওপর দোষ চাপায়। ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজে। বিএনপি যেমন ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের হারকে মানতে পারেনি, তেমনি আওয়ামী লীগও ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের হারকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বলে শোরগোল তুলেছিল। দুই দলই নিজেদের জনপ্রিয়তাকে চিরন্তন বলে দাবি করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা জারি থাকতে সেই জনপ্রিয়তা মাপার একটা সুযোগ ছিল। এখন সেটিও নেই।

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেন। আবার তাঁরাই যে দফায় দফায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রকাশ্য ও নেপথ্যের কুশীলবের কাছে ধরনা দিয়েছেন, তার বহু প্রমাণ আছে।

ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন করার জন্য জবরদস্তি না করলে রিজভীর ভাষায় এক–এগারোর অসাংবিধানিক সরকারের প্রয়োজন না–ও হতে পারত। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা মাহ্‌ফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৮৩টি মামলা করেছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে। আর এখন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব তাঁর বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহের সমতুল্য বলেছেন। রাষ্ট্রপ্রেমিকের যথার্থ বয়ানই বটে।

● সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]