বিকট প্রেম, বীভৎস প্রতিহিংসা

কখনো হাতুড়ি বা ইট দিয়ে বাড়ি মারতে মারতে মাথা-মুখ থেঁতলে দেওয়া। কখনো কুপিয়ে ফালা ফালা করা। কখনো অ্যাসিড ছুড়ে চোখ-মুখ-শরীর ঝলসে তছনছ করে দেওয়া। কখনো উৎপীড়ন করে করে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া।
সবই প্রেমের নামে।
সাংবাদিক অভ্যাসের টানে লিখে দেন, ‘প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায়...।’ অথবা ‘প্রেমের সম্পর্ক রাখতে না চাওয়ায়...।’
কী বিকট এই প্রেম, প্রত্যাখ্যাত হলে যা বদলে যায় বীভৎস প্রতিহিংসায়!
বুধবারের প্রথম আলোয় খবরটা পড়ি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ছবি তুলতে গিয়েছিলেন বাঘা উপজেলার তেঁতুলিয়া বাজারের এক স্টুডিওতে। পরে স্টুডিওর মালিক রাকিবুল ইসলাম তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। মেয়েটি রাজি হননি। রাকিবুল একদিন মেয়েটির বাড়িতে হাজির হলে বাড়ির লোকেরা তাঁকে মারধর করেন। মঙ্গলবার মেয়েটিকে এলাকার রেলস্টেশনে পেয়ে রাকিবুল তাঁর এক বন্ধুকে নিয়ে মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তাঁর মাথা ক্ষতবিক্ষত করে দেন। মেয়েটির অবস্থা এখন শঙ্কামুক্ত। মামলা হয়েছে। রাকিবুল এখন কারাগারে।
গত ১ সেপ্টেম্বর বন্ধুর জন্মদিনে যাওয়ার কথা বলে ময়মনসিংহ শহরের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন আফসারী আক্তার, ডাক নাম স্বর্ণা। স্বর্ণা গিয়েছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ উদ্যানে। আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগে স্নাতক পর্বের ছাত্রী স্বর্ণার একসময় সম্পর্ক ছিল প্রতিবেশী ও একই কলেজের ছাত্র আবদুস সামাদ ওরফে রাজুর সঙ্গে। ওই দিন রাজু সম্ভবত তাঁর পিছু নিয়েছিলেন। উদ্যানে মেয়েটি যখন রাকিব নামের বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন, তখন রাজু গিয়ে তাঁকে কৌশলে একান্তে ডেকে নেন। তারপর তিনি ইটের বাড়ি মেরে স্বর্ণার মুখ-মাথা থেঁতলে দিয়ে পালিয়ে যান। পাঁচ দিন মস্তিষ্ক অকার্যকর অবস্থায় থেকে ৬ সেপ্টেম্বর স্বর্ণা মারা যান।
রাজু এখনো পলাতক। গতকাল স্বর্ণার বাবা ব্যবসায়ী আতাউর রহমানকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ মুখে মুখে খুব আন্তরিক। কিন্তু আসামি ধরার ব্যাপারে তেমন আন্তরিক মনে হয় না। কাজের অগ্রগতি কিছুই দেখছি না।’ পুলিশ অবশ্য রাজুর বাবাকে আটক করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
স্বর্ণা ছিলেন আতাউরের দুই মেয়ের মধ্যে বড়। আতাউর বলেন, ‘আমার মেয়ে অন্যায় করতে পারে, তাই বলে মেরে ফেলবে? আমি দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই, রাজুর সর্বোচ্চ সাজা চাই।’ এখন তাঁর সবটা সময় কাটে কষ্টের মধ্যে। ‘দোকানে কিছু কিনতে গেলে মনে হয়, আগে দুই মেয়ের জন্য কিনতাম। খেতে বসলে মনে হয়, পাশে আমার দুই মেয়ে বসত।’ ফোনের ওপারে তাঁর গলা আবছা হয়ে ভিজে ভেসে যায়।
স্বর্ণার মৃত্যুর আগের দিন সকালে ক্লাসে যাচ্ছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী সাওদা। পথে তাঁকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যান একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাসেল মাতুব্বর। এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নেওয়ার পর বিকেল পাঁচটায় সাওদা মারা যান। রাসেল ধরা পড়েন পরের সপ্তাহে।
একই এলাকার ছেলে রাসেলের সঙ্গে সাওদার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু রাসেল বিয়ে করতে চাইলে সাওদা বলেছিলেন, আগে লেখাপড়া শেষ করতে চান। ঘটনার কিছুদিন আগে এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাসেল সাওদাকে পেটান। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা তখন মেয়েটিকে বাঁচান। সাওদার বড় মামি দিলরুবা আক্তার এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। গতকাল তিনি টেলিফোনে বলেন, তখন সাওদাকে আর বিরক্ত না করার লিখিত অঙ্গীকার করেছিলেন রাসেল।
সাওদার শেষ সময়েও সঙ্গে ছিলেন দিলরুবা। ‘এই কারণে কি মেরে ফেলবে?’ তিনি প্রশ্ন করেন, হয়তো নিজেকেই।
স্বর্ণার মামলার মতো এ মামলারও অভিযোগপত্র দাখিল হয়নি। দিলরুবা বলেন, ঈদের দু-তিন দিন আগে তিনি খোঁজ নিলে তদন্তকারী কর্মকর্তা নাকি বলেছেন, ঢাকা থেকে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন না পাওয়ায় দেরি হচ্ছে।
দিলরুবার মনে হয়েছে, পুলিশের যথেষ্ট উদ্যম নেই। তিনি বলেন, আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করেছেন রাসেল। যে দা দিয়ে সাওদাকে রাসেল মেরেছেন, সেটির গায়ে নাকি মেয়েটির নাম খোদাই করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।
ঘটনা তো তিনটি মাত্র নয়। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই এই জাতীয় নিপীড়নের খবরের সংখ্যাটা রোজই অসহনীয় বলে মনে হয়।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ওয়েবক্ষেত্রে ডজন খানেক জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা সালওয়ারি হিসাব মেলে। এ হিসাব বলছে, ২০১২ সালে যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন মোট ২৫০ জন নারী। তাঁদের মধ্যে ১৬ জন আত্মহত্যা করেছেন আর খুন হয়েছেন ছয়জন। ২০১১ সালে আত্মহত্যা করেছিল ৩৩ জন এবং খুন হয়েছিল চারজন মেয়ে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আত্মহত্যা করেছে ছয়জন মেয়ে। যৌন হয়রানির সামনেও প্রায়ই থাকে ‘প্রেমের প্রস্তাবের’ ধ্বজা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৯ থেকে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার ৪০০ জন নারী ও মেয়েশিশু অ্যাসিড-আক্রান্ত হয়েছে। আক্রমণের একটি বড় কারণ প্রেম, বিয়ে বা শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। গত বছর অ্যাসিড-আক্রান্ত হয় ৬৮ জন নারী ও মেয়েশিশু, যাদের ১৯ জন এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।
ময়মনসিংহের স্বর্ণার বাবা বলেছিলেন, ‘এটা কীভাবে ভালোবাসা হয়?’ সত্যিই তো, গতকালের ভালোবাসা আজ কেউ অস্বীকার করলে কি তাকে হত্যা করা যায়? কাউকে ভালোবাসলে কি তাকে যৌন হয়রানি করা যায়? কাউকে ভালোবেসে প্রত্যাখ্যাত হলে কি অ্যাসিড ছুড়ে তার চেহারা বিকৃত ও জীবন দুর্বিষহ করে দেওয়া যায়?
আসলে এমন ‘বিকট প্রেমের’ ভেতরের কথাটি হচ্ছে ‘আমাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস তোর হয় কী করে? আমি যা চাই, তা-ই তোকে করতে হবে।’ ক্ষমতা আর আধিপত্যের বোধই এর প্রধান উপাদান, যা কি না মেয়েদের প্রতি সহিংসতার আদি উৎস। ধর্ষণের মনোবৃত্তির সঙ্গে (গত বছর ঘটেছে ৯৮ খুনসহ অন্তত এক হাজার) এমন প্রেমের বিশেষ ফারাক নেই।
এসব অপরাধের বিচার ও সাজার অপ্রতুলতা তো আছেই, সমাজে এ মানসিকতার পক্ষে সুপ্ত অনুমোদনও কি নেই?
আসকের হিসাব বলছে, উত্ত্যক্তকারীদের বাধা দিতে গিয়ে ২০১২ সালে নয়জন এবং ২০১১ সালে ১৯ জন পুরুষও খুন হন। গত বছরের ঘটনাগুলোর প্রতিবাদকারীদের মধ্যে শ দুই পুরুষ ছিলেন। কিন্তু রোজকার চলাফেরার মধ্যে যাঁদের সঙ্গে কথা হয়, তাঁদেরই কারও কারও কথায় এসব আক্রমণের শিকার মেয়েদের আচরণের প্রতি দোষারোপের সুর থাকে। এমন কথাও শুনি, এগুলো মেয়েদের অবাধ ঘোরাফেরা ও নারী-পুরুষ মেলামেশার কুফল। মেয়েরা পর্দার মধ্যে থাকলে নাকি এগুলো ঘটবে না। যুক্তি-বুদ্ধি কিন্তু বলে, তেমনটা হলে মূলের আধিপত্যবোধই জোরদার হবে।
এদিকে এ মুহূর্তে আরেক বিকট তুফানের ছায়া দেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। সবাই আমরা আতঙ্কিত হয়ে পথ খুঁজছি। দুঃখ এই যে, ওপরে আলোচিত বিকট সমস্যাটি এভাবে সবার মনোযোগ পায় না—সমান মাত্রায় আতঙ্কজনক হওয়া সত্ত্বেও।
কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনা: সাংবাদিক।