বিচারবহির্ভূত সব হত্যার শুনানি হোক

কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সংবাদমাধ্যমে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ আসছে। সিনহা হত্যার বিষয়ে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির গণশুনানিতেও বহু মানুষ তাঁদের অভিযোগ জানাতে হাজির হয়েছিলেন। কিন্তু সিনহা হত্যার বিষয়টি ছাড়া অন্য কোনো অভিযোগ কেউ শোনেননি। গত সপ্তাহখানেকের সংবাদ শিরোনামগুলো থেকে ধারণা করা যায়, জাতীয় পর্যায়ে যদি কোনো গণশুনানির ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে তা সামাল দিতে কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হবে। দু-চার দিনে বা সপ্তাহে, এমনকি কয়েক মাসেও তা শেষ করা সম্ভব হবে কি না, সন্দেহ।

তবে সময় যা-ই লাগুক, কিংবা তার আয়োজন যতই কঠিন হোক, গত দুই দশকের চার হাজারের বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের মতো গুরুতর অপরাধের অভিযোগগুলোর বিষয়ে এ ধরনের শুনানি যে কতটা প্রয়োজন, তা কক্সবাজারের নজির থেকে স্পষ্ট হয়েছে। স্মরণ করা দরকার, সিনহার পরিবার ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাকল্যাণ সমিতির (রাওয়া) পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, তারা আশা করে, সব বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অবসান ঘটবে এবং ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বিচার পাবে।

বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন (ক্যাডার সার্ভিসের সদস্যদের সমিতি) অবশ্য এক বিবৃতিতে বলেছে, কোনো ব্যক্তির অপকর্মের দায় পুলিশ গ্রহণ করে না। বিবৃতিতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে অতীতে ব্যবস্থা নিয়েছে; ভবিষ্যতেও নেবে। বিবৃতিটি যেদিন ছাপা হয়েছে, সেদিনের সংবাদপত্রগুলোর শিরোনামে কিন্তু ভিন্ন চিত্র মেলে। সেদিনের ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত ‘কমপ্লেইন্টস অ্যাগেইনস্ট কপস: ফ্লাডগেটস ফ্লাং ওপেন’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি মূলত তার আগের কয়েক দিনের খবরগুলোর সংকলন। কক্সবাজারের ঘটনা ছাড়া সেখানে আরও তিনটি খবরের কথা বলা হয়েছে: এএসআইকে থাপ্পড় মারায় বামনার ওসিকে প্রত্যাহার; কোতোয়ালির ওসি এবং চারজন পুলিশের বিরুদ্ধে জোর করে টাকা আদায়ের মামলা; যুবলীগ নেতাকে নির্যাতনের জন্য দুর্গাপুর থানার ওসিকে প্রত্যাহার।

একই সময়ে অন্য কয়েকটি মাধ্যমে প্রকাশিত খবরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: রাজশাহীর রেঞ্জ এসপির বিরুদ্ধে ঢাকায় অপহরণ এবং জবরদস্তি টাকা আদায়ের মামলা; কক্সবাজার জেলাতেই সদর থানার ওসির বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের মামলা; মিরপুরে থানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধেই ক্ষমতাসীন দলের এক নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রভৃতি। এ রকম অভিযোগ আরও আসছে। ১৭ আগস্ট ইত্তেফাক-এর প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘৫০ লাখ টাকা না পেয়ে প্রবাসীকে “ক্রসফায়ার”’। অভিযোগ চকরিয়ার ওসির বিরুদ্ধে। চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনারের গত সেপ্টেম্বরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, তিনি মাদকের কারবারিদের মোকাবিলায় অস্ত্র ব্যবহারের কথা বেশ জোরের সঙ্গেই তুলে ধরছেন।

খবরগুলো স্পষ্টতই অন্তত তিনটি প্রবণতা তুলে ধরছে। প্রথমত, ক্রসফায়ার পুলিশের বহুল ব্যবহৃত এবং সম্ভবত নীতিগত ও অতিপছন্দনীয় কৌশল। দ্বিতীয়ত, এই বাহিনীর মধ্যে লোভ ও ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তৃতীয়ত, পুলিশ বাহিনীতে এ ধরনের অপরাধগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করার ব্যবস্থা কার্যত নেই বা যতটুকু আছে, তা ব্যর্থ।


এগুলোর কোনোটিকেই কোনো একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবে গণ্য করার অবকাশ কোথায়? গুরুতর অপরাধের অভিযোগের মুখে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার কীভাবে উপযুক্ত ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে? প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত এসব ত্রুটি বা সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে শুধু সময়ে সময়ে আলোড়ন জাগানো ঘটনাগুলোকে ঘিরে নানা ধরনের জল্পনা, বিতর্ক কিংবা আশ্বাসে কখনোই সমস্যার সমাধান হবে না। সিনহা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবির সঙ্গে তাই পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের দাবিকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া অপরাধের দায় কেউ নেবে না, বরং বাহিনীর সতীর্থদের সুরক্ষা দেওয়াই তখন অন্যদের অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়াবে। এখন পর্যন্ত সেই ধারাই চলছে।

পুলিশের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের বিষয়ে বাংলাদেশে অবশ্য কথা কম হয়নি। কিন্তু সংস্কারের গতিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়ন এবং পুলিশ বাহিনীর সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি সমীক্ষার প্রতিবেদন এবং সুপারিশমালা সরকারের কাছে জমা পড়ে ২০১২ সালের জুলাই মাসে (পুলিশ রিফর্ম অপরচুনিটিস ফর বাংলাদেশ, সঞ্জয় পাতিল)। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬১ সংশোধনের ওপর। এতে বলা হয়, গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুযায়ী আইন এবং জনগোষ্ঠীর কাছে জবাবদিহির বদলে পুলিশ অ্যাক্টে সরকারের কাছে জবাবদিহিতে জোর দেওয়া হয়েছে। কেননা, গণতন্ত্রে পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে আইনের প্রতি এবং জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জবাবদিহি করা। এতে বলা হয় যে পুলিশের অসদাচরণের অভিযোগ স্বাধীনভাবে বাইরের কারও পর্যালোচনার ব্যবস্থা না রেখে বাংলাদেশ পুলিশ যে অভ্যন্তরীণ নজরদারির ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে, তা এর জাজ্বল্যমান প্রমাণ।

পুলিশে সংস্কারের কিছু পদক্ষেপ যে নেওয়া হয়নি, তা নয়। কিন্তু সংস্কারের সবচেয়ে জরুরি অংশটি থমকে আছে। ১৮৬১ সালের আইন বদলানোর জন্য ‘পুলিশ অ্যাক্ট ২০১৩’ নামে একটি খসড়া তৈরি হলেও তা অনুমোদনের প্রক্রিয়া আটকে গেছে। ইউএনডিপি ও ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক সহায়তা বিভাগ ডিএফআইডির সহায়তায় সংস্কার প্রক্রিয়ার ২০১৫ সালের মূল্যায়নে এই আইন সংস্কারের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়েছে। আধুনিকায়নের নামে কিছু মডেল থানা হয়েছে, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার হয়েছে, আধুনিক প্রযুক্তিও যুক্ত হয়েছে। সামাজিক অংশগ্রহণের নামে কিছু থানায় স্থানীয় নাগরিকদের নিয়ে সভা করার একটা চলও শুরু হয়েছিল, যা শেষতক ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের প্রভাব বিস্তারের আনুষ্ঠানিক ফোরামে পরিণত হয়েছে। পুলিশের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে বহুগুণে। কিন্তু সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লোভ-দুর্নীতিও বেড়েছে, ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ অনেক বেড়েছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য স্বাধীন ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান না থাকায় বাহিনীটির সদস্যরা বিচার থেকে রেহাই পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। এই দায়মুক্তির বিষয়টিকে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছে। কমিটি বলেছে, নিজেদের একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থার বদলে এই বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ একই ইউনিটের কর্মকর্তা বা তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদন্ত করলে সেখানে যে স্বার্থের সংঘাত থাকে, তা উদ্বেগের বিষয়। এ কারণে কমিটি এমন একটি স্বাধীন তদন্ত সংস্থা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে, যাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কেউ সদস্য থাকবেন না। কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে অভিযোগকারী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টিও বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে। নিহত সিনহার সহযোগীদের ভীতি প্রদর্শন ও হয়রানি, বিশেষত নারী সহকর্মীকে অনলাইনে হেনস্তা করায় জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এ ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাই তুলে ধরেছে।

দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সংকলিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা যখনই বেড়েছে, তখনই বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মতো ঘটনাগুলো অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এমনকি মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর সময়টিও রাজনৈতিক বিতর্কের কারণ হয়েছে। কেননা ২০১৮ সালের নির্বাচনের ঠিক সাত মাস আগে এই অভিযান ঘোষিত হয় এবং শুরুতে বিরোধী দলের বেশ কিছু কর্মী তাতে নিহত হন। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠে সে বছরেরই জাতীয় নির্বাচনে।


বৈশ্বিক পরিসরে নানা রাজনৈতিক সমস্যা-সংকট নিয়ে গবেষণা ও নীতি-সুপারিশের জন্য সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বাংলাদেশ পুলিশের বিষয়ে এক যুগ আগে এক নিবন্ধে বলেছিল, মানবাধিকার লঙ্ঘন দেশব্যাপী বিস্তৃত এবং পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছে এমন সব বাংলাদেশিরই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তারা একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল, ‘পুলিশকে যদি রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে ব্যবহার করা অব্যাহত থাকে, তাহলে এই বাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, যাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের সরকারগুলোকে অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে’ (বাংলাদেশ: গেটিং পুলিশ রিফর্ম অন ট্র্যাক, ১১ ডিসেম্বর ২০০৯)।

বিরোধী দল ও ভিন্নমত দমনে বেআইনি বলপ্রয়োগ, নির্বাচনগুলো কবজা করতে ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের মতো ভূমিকা গ্রহণ এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দায়মুক্তি আদায়ে পুলিশের ভূমিকা থেকে এমন প্রশ্ন জাগা অযৌক্তিক হবে না যে আইসিজির সাবধানবাণী ইতিমধ্যেই বাস্তব রূপ নিয়েছে। তাই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন পুলিশের কার্যকর জবাবদিহির ব্যবস্থা করার লক্ষ্যে দ্রুত সংস্কার করা; প্রয়োজন বিচারবহির্ভূত সব হত্যা ও গুমের ঘটনার সত্য উদ্‌ঘাটনে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠান।


কামাল আহমেদ: সাংবাদিক