বিচ্ছেদ এড়াতে যা দরকার

কিছুদিন আগে প্রথম আলোতে ‘ঢাকায় দিনে ৩৯ তালাক’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন মহলে সংবাদটি নিয়ে নানা রকম আলোচনা হতে শুনেছি। তথ্যটি জেনে অবাক হয়েছেন অনেকেই। মনে পড়ে, ২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম আলোতেই এ ধরনের আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘ঢাকায় ঘণ্টায় এক তালাক’। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মাসে গড়ে ৭৩৬টি হিসাবে দিনে ২৪টির বেশি এবং ঘণ্টায় একটি তালাকের আবেদন করা হচ্ছে। দুই বছরের ব্যবধানে তালাকের আবেদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দুই বছর আগে যেখানে ৬০ মিনিটে একটি তালাকের ঘটনা ঘটত, এখন সেটি বেড়ে ৩৭ মিনিটে একটি হয়েছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়ে যাওয়ার পেছনে করোনার ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক চাপকে দায়ী করা হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের এই ঊর্ধ্বগতিতে করোনার হাত হয়তো কিছুটা আছে, তবে অভূতপূর্ব এই পরিস্থিতি না এলেও এই সংখ্যা খুব একটা সুখকর হতো বলে মনে হয় না। ২০১৮ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বরাত দিয়ে বলা হয়েছিল, বিগত সাত বছরে তালাকের প্রবণতা ৩৪ শতাংশ বেড়েছে।

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদের প্রবণতা। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ ২০২০–এর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বে বিবাহবিচ্ছেদের শীর্ষে আছে রাশিয়া, গুয়াম, বেলারুশ, লাটভিয়া ও ইউক্রেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পিছিয়ে নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১৩ সেকেন্ডে একটি করে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। সেখানে ৫০ শতাংশ বিয়ের পরিণতি গড়াচ্ছে বিচ্ছেদে। মুসলিম দেশগুলোতেও বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ। খোদ সৌদি আরবেই বাড়ছে বিচ্ছেদের হার। আর লকডাউনে এই হার বেড়েছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত। ইরানে বেড়েছে বিবাহবিচ্ছেদের হার। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে তেহরান। সেখানে এক–তৃতীয়াংশ বিয়েই বিচ্ছেদে গড়াচ্ছে।

অন্যদিকে বিশ্বের কম বিবাহবিচ্ছেদপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকা। যদিও এই দেশগুলোতেও বিবাহবিচ্ছেদের হার ক্রমবর্ধমান। ২০১৮ এবং ২০২০ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত দুটি রিপোর্টেই তালাকের কারণগুলো ছিল প্রায় এক ও অভিন্ন। দুটি রিপোর্টেই বলা হয়েছে, শিক্ষিত স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বেশি তালাক হচ্ছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নারীরাই তালাকের আবেদন করছেন বেশি। তালাক আবেদনের ক্ষেত্রে শুধু যে বাংলাদেশের নারীরাই এগিয়ে আছেন, তা কিন্তু নয়। সারা পৃথিবীতেই একই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।

তালাকের সংখ্যার এই দ্রুত বৃদ্ধির জন্য স্বাভাবিকভাবেই দায়ী করা হচ্ছে নারীর পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থানকে। নারীর নতুন সামাজিক অবস্থানের পেছনে কাজ করছে মূলত নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা। আসলে শিক্ষার সঙ্গে অন্য বিষয়গুলো নিবিড়ভাবে জড়িত। শিক্ষার অধিকার মৌলিক অধিকার হলেও অনেক যুগ ধরে নারী এই অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল। আজ যখন শিক্ষিত, স্বাবলম্বী নারী তাঁর অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছেন, ঠিক তখনই দেখা দিচ্ছে ব্যক্তিত্বের তীব্র দ্বন্দ্ব আর সংঘাত। বাড়ছে নারী-পুরুষের মানসিক দূরত্ব, বাড়ছে নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতন ও সহিংসতা।

যেহেতু নারীই পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন অনেক বেশি, তাই তাঁরা একসময় বিচ্ছেদের সিদ্বান্ত নিচ্ছেন। সংঘাতময় এই পরিস্থিতিতে বারবার শিক্ষিত নারীকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে; যেন শিক্ষিত হওয়া নারীর অপরাধ। শিক্ষিত নারীর ব্যক্তিত্বই যেন পারিবারিক বন্ধনকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, সংসার টিকিয়ে রাখার ব্যর্থতার জন্য শিক্ষিত নারীকে যতটা দায়ী করা হচ্ছে, শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী নারীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারার জন্য পুরুষকে ততটা দায়ী করা হচ্ছে না।

আমি মনে করি, আজকের নারীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার ব্যর্থতা প্রথমত পুরুষের। এরপর করা যেতে পারে নারীর ব্যর্থতার বিশ্লেষণ। বিগত এক-দেড় দশকে নারীর সামাজিক অবস্থানের দৃশ্যমান পরিবর্তন হলেও পুরুষের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়নি। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, সংসারের এই ভাঙনের পেছনে দায়ী প্রকৃতপক্ষে নারীর শিক্ষা নয়; বরং এর দায় পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চার, যা নারীর অস্তিত্ব আর অধিকারকে পূর্ণভাবে স্বীকার করে না। আজকের নারী তাই পুরুষের এই মানসিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ফলে বাড়ছে দ্বন্দ্ব।

অনেকে আজও মানতে পারেন না যে নারী কথা বলবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন, নিজের অস্তিত্বের কথা জানাবেন। আজকের দিনেও অনেক পুরুষদের মগজে আছে সেবাদানকারী নারীর সেই প্রতিমূর্তি; যিনি নিঃশব্দে শুধু কাজ করে যাবেন। তাঁরা শিক্ষিত নারী চাইবেন, অথচ শিক্ষার ফলে নারীর রূপান্তরকে তাঁরা অস্বীকার করবেন, অশ্রদ্ধা করবেন। এটি হতে পারে না।

প্রশ্ন হলো, এই দ্বন্দ্ব আর সংঘাতের সমাধান কী! সংসার টিকিয়ে রাখাই তো সমস্যার সমাধান নয়। করোনা মহামারি একসময় শেষ হবে; কিন্তু মানসিকতার পরিবর্তন না হলে পারিবারিক অশান্তির মহামারি কিন্তু কখনো শেষ হবে না। তাই প্রয়োজন সমস্যার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করা এবং সমস্যা সমাধানে কাজ করা। আজ সমাজে নারীর প্রতি যে অবজ্ঞা, অবহেলা আর যৌন সহিংসতার চরম প্রকাশ আমরা দেখি, তার জন্য বৈষম্যপূর্ণ পারিবারিক আর সামাজিক ক্ষমতাকাঠামোকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

এই পরিস্থিতির উত্তরণে নারীর চাইতে পুরুষের করণীয় অনেক বেশি বলে আমার মনে হয়। পুরুষের জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন শিক্ষিত নারীর নতুন রূপটিকে মেনে নেওয়া। অনেকে আজও মানতে পারেন না যে নারী কথা বলবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন, নিজের অস্তিত্বের কথা জানাবেন। আজকের দিনেও অনেক পুরুষদের মগজে আছে সেবাদানকারী নারীর সেই প্রতিমূর্তি; যিনি নিঃশব্দে শুধু কাজ করে যাবেন। তাঁরা শিক্ষিত নারী চাইবেন, অথচ শিক্ষার ফলে নারীর রূপান্তরকে তাঁরা অস্বীকার করবেন, অশ্রদ্ধা করবেন। এটি হতে পারে না।

মনে রাখতে হবে শিক্ষিত, প্রগতিশীল নারী এখনকার বাস্তবতা। অচিরেই নারীর নতুন রূপটিকে মন থেকে গ্রহণ না করতে পারলে এই দ্বন্দ্ব দিন দিন প্রকট হবে। সময়টি যুগসন্ধিক্ষণের। তাই একদিকে যেমন নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এখন থেকেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলার শিক্ষা দিতে হবে। অন্যথায় লাখ লাখ বিচ্ছেদের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক