বিদ্যালয়ে 'যোগ্যতাভিত্তিক' শিক্ষাক্রম?

‘উদ্দেশ্য মহত্, পদক্ষেপ ভুল’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। নিবন্ধকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান। তিনি প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বর্তমান পাঁচ বছর থেকে আট বছরে উন্নীত করার সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কিছু সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণী খোলার সরকারি পদক্ষেপকে ‘সম্পূর্ণ ভ্রান্ত’ আখ্যা দিয়েছেন তিনি। তিনি শিক্ষাক্রমের জন্য ‘আট বছরান্তে অর্জনোপযোগী প্রান্তিক শিখনফল’ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন। এর জন্য প্রয়োজন ‘প্রান্তিক শিখনফলগুলোকে বিভিন্ন বিষয়োপযোগী করে প্রথম থেকে অষ্টম—প্রতিটি শ্রেণীর জন্য শ্রেণীভিত্তিক অর্জনোপযোগী শিখনক্রমে সাজিয়ে সে অনুসারে পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য শিখনসমাগ্রী উন্নয়ন করা’।
নিবন্ধকারের ভাষ্য থেকে মনে হয়, বর্তমান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক একেবারে ভিন্নধারার। তাহলে তো প্রশ্ন জাগে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনাকারী বিজ্ঞজনেরা কোন অধিকারের বলে আমাদের পঞ্চম শ্রেণী পাস করা বালক-বালিকাদের ষষ্ঠ শ্রেণীর একেবারে ভিন্নধারার শিক্ষার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন? প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের শিক্ষাক্রমে একই ধারার ‘বিভিন্ন বিষয়োপযোগী’ এবং নির্দিষ্ট শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের অর্জনোপযোগী শিখনফল নির্ধারণ করে সেগুলো অর্জনের জন্য উপযুক্ত বিষয়বস্তু পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং, আমাদের শিক্ষাক্রম পরিমার্জনকারী বা পাঠ্যপুস্তক রচয়িতারা ‘দুই ধারার, সামঞ্জস্যহীন’ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মতো ‘অপরাধ’ করেননি।
যা-ই হোক, অধ্যাপক রহমানের নিবন্ধের ‘ব্যবস্থাপত্র’কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েই বোধ হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষাক্রমকে প্রাথমিক স্তরের মতো ‘প্রান্তিক যোগ্যতা’ভিত্তিক করে পরিমার্জন করার জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রতি নির্দেশ জারি করেছে। এ বিষয়ে একাডেমিক আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
শিক্ষার কিছু শাশ্বত উদ্দেশ্য রয়েছে যথা চিন্তন, ভাবাবেগ ও মনোপেশিজ ক্ষেত্র। প্রথম ক্ষেত্রটি হচ্ছে কোনো বিষয় জানা, বোঝা, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ বা মূল্যায়ন করতে পারার। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি হচ্ছে কোনো বিষয়ের প্রতি আবেগ থাকা বা দরদ তৈরি হওয়া; প্রথম ক্ষেত্রের বিষয়গুলো ভালোমতো জানা-বোঝা হলে সেগুলোর প্রতিও দরদ আসে। আর এরূপ দরদ, ভালোবাসা বা মায়া তৈরি হলে ‘জ্ঞানী’ ও ‘দরদি’ মানুষ (শিক্ষার্থী) কিছু কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং প্রয়োজনীয় ‘মনোপেশিজ’ দক্ষতা অর্জন করে।
উপর্যুক্ত তিনটি ক্ষেত্রের সব উদ্দেশ্যই অর্জন করা জরুরি। এতে শিক্ষা সার্বিক হয়। অথচ শুধু যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য মানুষকে কোনো নির্দিষ্ট পেশায় যোগ্য করে তোলা। তাই সারা পৃথিবীতে চিকিত্সাশাস্ত্র, নার্সিং, শিক্ষকতা, শিল্পকর্ম, গাড়ি চালনা ইত্যাদি পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের জন্য যোগ্যতা বা দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর কোর্স সমাপ্ত করেও ডিগ্রিধারীরা সরাসরি কোনো পেশায় নিয়োজিত হতে পারে। তাই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যেকোনো বিষয়ের শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক হওয়া সম্ভব। কিন্তু এরূপ শিক্ষাক্রম সাধারণ শিক্ষার প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরের জন্য উপযোগী নয়। এ স্তরের শিক্ষাক্রম যোগ্যতাভিত্তিক করা হলে শিক্ষা বালক-বালিকা বা তরুণ-তরুণীদের দেশপ্রেমিক, যথাযোগ্য নৈতিক মানসম্পন্ন ও মননশীল করে গড়ে তোলার পরিবর্তে শুধু নির্দিষ্ট কিছু কাজে দক্ষ যান্ত্রিক মানুষে পরিণত করতে পারে।
জে. ডেলরস (১৯৯৬) অবশ্য ভাবাবেগের ক্ষেত্রকে শিক্ষার উদ্দেশ্যের অন্যান্য ক্ষেত্রের সঙ্গে সমন্বয় করে সব স্তরের জন্যই সমন্বিত যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা যায় বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু গত দেড় যুগেও পৃথিবীর কোথাও তা সফল হওয়ার নজির নেই।
বাস্তবে ফ্রান্সের জে. ডেলরস খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ হলেও ইউনেসকোর কাছে জমা দেওয়া তাঁর ‘এডুকেশন: দ্য ট্রিয়েজার উইথইন’ শীর্ষক প্রতিবেদন ব্লুমের শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলোকে শ্রেণীকরণের সঙ্গে তুলনীয় একাডেমিক মানের কাজ নয়। ডেলরস শিক্ষার জন্য যে চারটি স্তম্ভের (১. লার্নিং টু নো, ২. লার্নিং টু ডু, ৩. লার্নিং টু বি এবং ৪. লার্নিং টু লিভ টুগেদার) কথা বলেছেন, এর প্রথমটিকে আমার কথার ফুলঝুরি বলে মনে হয়। কারণ ‘জানা’ই জ্ঞানচর্চার গোড়ার বিষয়, এটাকে ‘জানতে শেখা’ আকারে বর্ণনা করার উদ্দেশ্য অন্য তিনটির সঙ্গে জোর করে মেলানো। ডেলরসের যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমসম্পর্কিত ধারণা তাই সর্বজনগ্রাহ্য বিষয় হয়ে ওঠেনি।
জানা যায়, বাংলাদেশে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম সাধারণ শিক্ষায় আমদানি করা হয়েছে ভারতীয় শিক্ষা পরামর্শক আদর্শ খান্নার পরামর্শে। খান্নার পাণ্ডিত্য সর্বজনবিদিত নয় এবং গুগল বা স্কলারে সার্চ দিয়ে তাঁর রচিত কোনো বই বা জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের সন্ধান মেলেনি। তাঁর ১৯৯২ সালে শ্রীলঙ্কায় উপস্থাপিত একটি মাত্র সেমিনার (শিক্ষক প্রশিক্ষণবিষয়ক) প্রবন্ধের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটিও ভারত ও বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে।
তাহলে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ভুলবশত যোগ্যতাভিত্তিক করে ফেলায় কি এ স্তরের শিশুদের আমরা যান্ত্রিক করে ফেলছি না? আসলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্রম ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ করা হয়নি, শুধু এ শব্দগুচ্ছ অনেকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয় জাতির সামগ্রিক শিক্ষার কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য। এরপর নির্ধারিত উদ্দেশ্যগুলোকে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরের জন্য বিভাজন করা হয় এবং কোনো নির্দিষ্ট স্তরের বিষয় অথবা শ্রেণীভিত্তিক উদ্দেশ্যগুলোকে শ্রেণী অথবা বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করে সুনির্দিষ্ট, সূক্ষ্ম ও আচরণিক উদ্দেশ্যে ভাগ করা হয়। এগুলোকে বলা হয় ‘শিখনফল’। শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলোকে শিখনফলের মতো সুনির্দিষ্ট, সূক্ষ্ম ও আচরণিক করে তৈরি করায় এসব অর্জনের জন্য উপযোগী বিষয়বস্তুসংবলিত বই রচনা এবং শিক্ষার্থীর শিখন মূল্যায়ন করতে সুবিধা হয়। বাংলাদেশে কোনো স্তরের জন্য নির্ধারিত উদ্দেশ্যগুলোকে প্রথমে বিষয়ভিত্তিক করে, পরে প্রতিটি বিষয়ের উদ্দেশ্যগুলোকে ওই স্তরের বিভিন্ন শ্রেণীর উপযোগী শিখনফলে বিভাজন করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের শিক্ষাক্রম মূলত একই ধারার।
তবে প্রাথমিক স্তরের বর্তমান শিক্ষাক্রমে ১৩টি ‘উদ্দেশ্য’ নির্ধারণ করে সেগুলোকে ২৯টি ‘প্রান্তিক যোগ্যতায়’ বিভাজন করা হয়েছে। এগুলোকে পরে নির্দিষ্ট বিষয়ের অধীনে শ্রেণীভিত্তিক ‘প্রান্তিক যোগ্যতা’য় পুনরায় বিভাজন করে শেষ পর্যন্ত সূক্ষ্ম আচরণিক শিখনফলে রূপ দেওয়া হয়েছে। এভাবে এ স্তরের শিক্ষাক্রম ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। আমরা এবার এ দাবির সারবত্তা নিয়ে আলোচনা করতে পারি।
নির্ধারিত ১৩টি উদ্দেশ্যের প্রথমটি হচ্ছে: আল্লাহ তাআলা বা সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস ও শিশুর মধ্যে নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করা এবং সব ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এর তিনটি তথাকথিত ‘প্রান্তিক যোগ্যতা’ তৈরি করা হয়েছে: ১. সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা বা সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন, সব সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসায় উদ্দীপ্ত হওয়া; ২. নিজ নিজ ধর্মপ্রবর্তকের আদর্শ ও ধর্মীয় অনুশাসন অনুশীলনের মাধ্যমে নৈতিক ও চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন করা এবং ৩. সব ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্দীপ্ত ও শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এগুলো প্রকৃতপক্ষে ভাবাবেগের ক্ষেত্রে অবস্থিত ‘সাধারণ উদ্দেশ্য’, যোগ্যতা বা দক্ষতা নয় মোটেও। বাস্তবে ১৩টি বেশি প্রশস্ত আর ২৯টি কম প্রশস্ত উদ্দেশ্য। ‘প্রান্তিক’ শব্দটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় শিক্ষাক্রমে ব্যবহূত হয়েছে। এটির ব্যবহারও অতিকথন।
তাহলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের প্রশাসন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোন পথে এগোবেন? যৌক্তিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষাক্রমে ‘যোগ্যতা’ শব্দটির পরিবর্তে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ‘উদ্দেশ্য’ বা ‘শিখনফল’ শব্দ ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। তবে ‘যোগ্যতা’ শব্দটির প্রতি কারও বেশি আসক্তি থাকলে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষাক্রমেও ‘উদ্দেশ্য’ বা ‘শিখনফল’-এর পরিবর্তে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর মতো ‘যোগ্যতা’ শব্দ ব্যবহার করে সামঞ্জস্য বিধান করা যায়। কোনো ক্ষেত্রেই পাঠ্যপুস্তকে তেমন কোনো পরিবর্তন আনার দরকার হবে না। কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষাক্রমের সর্বশেষ ধাপে ‘শিখনফল’ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেগুলো অর্জনের উপযোগী ‘বিষয়বস্তু’ই পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা: ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ, এনসিটিবি।
[email protected]