বোবাধরা সময় কাটবে কবে?

বোবায় ধরলে মানুষ সব টের পায় কিন্তু কথা বলতে পারে না। ঘুমের মধ্যে বোবাধরার অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। তীব্র ভয়, চাপ, নিশ্বাসে অসুবিধা। অথচ পাশে শুয়ে থাকা কাউকেও জানানো যায় না। কী যে অসুবিধা! চিকিৎসাবিজ্ঞানে বোবাধরাকে বলে স্লিপিং প্যারালাইসিস।

গুম হওয়া লোকদের বেলায়ও দেখা যায়, তারা ফিরে যদিবা আসেনও কিন্তু ঘটনা বিষয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। তাঁদের মন ও বুদ্ধিকে তখন দাবিয়ে রাখে ভয়। আরও বিপদে পড়ার আতঙ্কে তাঁরা স্বজনের কাছেও মুখ খোলেন না। জানান না কাউকে যে কীভাবে তাঁরা গুম হন, কীভাবেই-বা তাঁরা ফিরে এলেন। গুম থাকার সময়ের সেসব অভিজ্ঞতা কাউকে যেন জানানোর নয়।

গত সপ্তাহে রংপুরের তরুণ ইসলামি বক্তা আদনান ত্ব-হা নিখোঁজ হলেন। পরিবার দাবি করল, তাঁকে গুম করা হয়েছে ঢাকা থেকে। ঢাকায় আসার পথে গাবতলীর কাছে তাঁর শেষ লোকেশন পাওয়াও গেল। অথচ তিনি কিনা বাড়ি ফিরলেন গাইবান্ধা থেকে। পুলিশের জবানিতে জানা যাচ্ছে, ত্ব-হা বলেছেন, তিনি পারিবারিক সংকটে পড়ে গাইবান্ধায় এক বন্ধুর বাড়িতে চার সঙ্গীসহ লুকিয়ে ছিলেন। বাকি তিনজনও পারিবারিক সংকটে পড়ে ‘আত্মগোপনে’ গিয়েছিলেন কী না, তা অবশ্য এখনো জানা যায়নি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী গত ১৩ বছরে (২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত) ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন। অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন, তার কোনো তথ্য নেই পরিবারের কাছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কোনো তথ্য দিতে পারছে না। গুমের তালিকায় রয়েছেন সাবেক সাংসদ, রাজনীতিক নেতা ও কর্মীদের পাশাপাশি সম্প্রতি যুক্ত হয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পুস্তক প্রকাশক, ব্যবসায়ী, ধর্মীয় বক্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা ও সাবেক কূটনীতিক। এত বিস্তৃত শ্রেণি-পেশার মানুষের গুম হওয়ার ঘটনা থেকে বোঝা যায়, এটা এখন এক সার্বিক নিরাপত্তা-তাণ্ডব হয়ে উঠেছে।

গুমের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা যা বলে, তাতে একটি লক্ষণ দেখা যায়। সাধারণত ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষের পুরুষেরাই গুম হন। কিন্তু গুম হওয়া স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি নিয়ে আন্দোলনে সামনে থাকেন নারীরা—নিখোঁজ মানুষদের স্ত্রী কিংবা মা অথবা বোনেরা। গুম একটা কৌশলগত রাজনৈতিক হাতিয়ার। এর উদ্দেশ্য কেবল চিহ্নিত প্রতিপক্ষকেই গায়েব করে দেওয়া না, এর লক্ষ্যের আওতা আরও বড়। এর লক্ষ্য সমাজের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ের বোধ চাঙা রাখা। তখন দেখা যায়, বোবায় কেবল গুম হওয়াদেরই ধরে না, অন্যদেরও ধরে।

যাঁরা আর ফিরে আসেন না, তাঁদের পরিবারকে বুকের মধ্যে এক শোকের কালো খাদ বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। বোবাধরা ভয়ে তাঁরা একসময় চুপ হয়ে যান। যদি তাঁদের কেউ আবারও গুম হন, সেই ভয়। যাঁরা ফিরে আসেন, তাঁদের সংখ্যা কম। তাঁদের মারাত্মক মানসিক ধাক্কা বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। অনেকে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে যান। অনেকে আর আগের পেশায় থাকতে পারেন না। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরাই ছিলেন পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। তাঁদের নিকটজনেরাও ভয়ে তাঁদের সঙ্গ এড়িয়ে যান।

এভাবে গুমের শিকার জীবিত ব্যক্তিরা তো বটেই, তাঁদের আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পুরো সমাজকেই যেন বোবায় ধরে ফেলে। একধরনের বোবাধরা ভয় সংক্রমিত হয় জন থেকে জনে। ভয়ের এই সংস্কৃতিতে স্বাভাবিক জীবন বলে কিছু থাকে না অনেকের।
বাংলাদেশে কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা গুম হওয়া ব্যক্তির রাজনীতি বা চরিত্র দেখে গুমকে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলেন। দোষী হলে বিচার করার দাবি জানান, কিন্তু গুম করা তো আরেকটা অপরাধ। সমাজ কথাটার মধ্যে ‘সম’তার ধারণা আছে। আমাদের সংবিধানের ভিত্তিতেই রয়েছে সব নাগরিকের সমান অধিকারের স্বীকৃতি। যে অধিকার পাকিস্তান দিত না বলেই বাংলাদেশ যুদ্ধ করে আজ স্বাধীন।

গুমের হাতকে যাঁরা শক্তিশালী করে যাচ্ছেন, তাঁরা খেয়াল করে দেখুন, সব চিন্তা ও শ্রেণির লোকই কিন্তু গুমের শিকার হচ্ছেন। আজ কারও গুম হওয়া নিয়ে মশকরায় যিনি মাতছেন, তিনি জানেন না গুমযন্ত্র যত শক্তিশালী হবে, ততই তা নির্বিচারবাদী হবে। যাকে-তাকে ধরবে।

কিন্তু ইতিহাসকে দীর্ঘ সময় বোবা করে রাখা যায় না। গুম ও তার মদদদাতাদের পরের প্রজন্মগুলো ক্ষমা করে না। স্বৈরাচারী বা সামরিক শাসনের সময় আর্জেন্টিনা, চিলি, মেক্সিকো ও ফিলিপাইনের মতো দেশে অনেক মানুষ গুম হন। কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এলে গুমের বোবাধরা ভয় কাটে। মানুষ তখন মুখ খোলে।সরকার ট্রাইব্যুনাল বসাতে বাধ্য হয় এবং বিচার শুরু হয়।

গত মাসে মেক্সিকোয় গুমের দায় ৩০ জন সেনা কর্মকর্তার বিচার চলছে। চিলির গুম নিয়ে কস্তা গাভরাসের চলচ্চিত্র ‘মিসিং’-এ অনেক তথ্য উন্মোচিত হয়। এমন উদাহরণ অজস্র। ইতিহাসকে কখনো গুম বা বোবা করে রাখা যায় না। জাতিসংঘে বাংলাদেশের গুমের বিস্তার নিয়ে কথা হয়েছে। মার্কিন সিনেটও বিষয়টা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে।

সুতরাং গুম হওয়া মানুষদের নিয়ে কথা হবেই, ফিরে আসা মানুষ এবং তাঁদের স্বজনেরা একসময় সাক্ষ্য দেবেনই। বোবাধরাকাল কাটবেই।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
faruk. wasif@prothomalo. com