ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভারতীয় রাজনীতি

অনেক বছর পর ভারতের সাধারণ নির্বাচন সম্ভবত আরও একবার দারুণভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠতে চলেছে। এবং সেই ব্যক্তিকে ঘিরেই গড়ে উঠছে আশা-নিরাশার এক অদ্ভুত দোলাচল।

ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে এশিয়ার মুক্তিসূর্য হয়েছিলেন। ’৭৭ সালের ভোটে তিনি তীব্র নিন্দিত, সমালোচিত কিন্তু প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। সেই ভোট জয়প্রকাশকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছিল। ’৮৪ সালে ইন্দিরার অকালনিধন। না থেকেও ইন্দিরাই ছিলেন পরবর্তী ভোটে প্রাসঙ্গিক। ’৮৯ সালে রাজীব গান্ধীকে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত করে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং মাথা তুলেছিলেন ঠিকই কিন্তু কলকে পায় একটি স্লোগান, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, রাজীব গান্ধী চোর হ্যায়’, যা দুর্নীতিকে করে তোলে একমাত্র নির্বাচনী ইস্যু। সেই থেকে আর কোনো ব্যক্তি কোনো ভোটেই সার্চ লাইটের প্রায় সব আলো নিজের মুখে টেনে আনতে পারেননি। ভোট হয়েছে ইস্যুভিত্তিক, দল বা জোটকেন্দ্রিক। ব্যক্তি অবশ্যই প্রাসঙ্গিক হয়েছেন, অটল বিহারি বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদভানি অথবা মনমোহন-সোনিয়া জুটি। কিন্তু দল বা দলের কর্মসূচিকে ছাপিয়ে কারও মাথা সেভাবে উঁচু হয়নি। এবার সম্ভবত যা হতে চলেছে।

নরেন্দ্র মোদি। এমন নয় যে, একটানা তিনবার এ দেশে মোদি ছাড়া আর কেউ মুখ্যমন্ত্রী হননি। জ্যোতি বসু হয়েছেন, মানিক সরকার হয়েছেন, লালু প্রসাদ, নবীন পট্টনায়ক, শীলা দীক্ষিত, রামন সিংরা হয়েছেন। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একাধিক নেতাও রয়েছেন এই তালিকায়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে যা চলছে, উন্মাদনা অথবা পাগলামি, তা অভূতপূর্ব। এমন কোনো আহামরি জাতীয় পর্যায়ের নেতা তিনি নন, এমন কোনো দৃষ্টান্তমূলক কাজের ছাপ তিনি রাখেননি, যা অদৃষ্টপূর্ব (অকাজের উদাহরণ অবশ্যই রয়েছে, গোধরা), এমন কিছুর আভাস তিনি এখনো দেননি, যা দেখে বা শুনে মানুষ আহা আহা করে উঠতে পারে। তাঁর দলের শীর্ষ নেতা আদভানিই তো প্রকাশ্যে মধ্য প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের কাজকে মোদির তুলনায় এগিয়ে রেখেছেন। এসব সত্ত্বেও কিন্তু মোদিময়ই হয়ে রয়েছে সাম্প্রতিক রাজনীতি। একটাই আগ্রহ, মোদিই বিজেপির সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী কি না।  

সন্দেহ নেই, মোদিই এই খেলাটা শুরু করেছেন, খেলাটা জিইয়েও রেখেছেন। তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী (তা তিনি হতেই পারেন এবং তাতে দোষের কিছু নেই), নিজের প্রতি তাঁর বিশ্বাস অগাধ (মনে করেন, দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর আঠারো আনা), মনে করেন, তাঁর উন্নয়নের মডেল ইউনিক (যদিও গুজরাট আজ বহু বছর ধরেই শিল্পায়নে সওয়ার) এবং বিশ্বাস করেন, দেশের মানুষ ২০০২ সালকে (গুজরাট দাঙ্গা) পেছনে রেখে তাঁর হাত ধরে এগিয়ে যেতে তৈরি। রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ও (ছয় কোটির মাত্র ৬ শতাংশ) তাঁকে ক্ষমাঘেন্না করে দিয়েছে বলে ভাবতেও তিনি পছন্দ করেন। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর ধারণা, দলে তাঁর মাথাই এ মুহূর্তে সবার চেয়ে উঁচু। অতএব ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতম প্রার্থী একমাত্র তিনিই। এই বিশ্বাসে হাওয়া দেওয়ার মতো অনুগামী তাঁর দলে যেমন বিস্তর, তেমনই রয়েছে বিরুদ্ধ মত। মোদিপন্থীরা মনে করেন, তিনি হিন্দুত্বের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছেন, যার দরুন মোদির পেছনে নেমে আসবে অভূতপূর্ব সমর্থনের ঢল। বিরুদ্ধবাদীরা মানতে নারাজ। তাঁদের কাছে মোদি এখনো দাঙ্গাবাজের এক ও অদ্বিতীয় প্রতীক। ফলে মোদিমুখী হলে বিপর্যয় অবধারিত। মজার বিষয়, সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা আসছে তাঁর কাছ থেকে, যাঁর রথযাত্রায় সারথির ভূমিকা পালন করেছিলেন মোদিই। আবার, রাজধর্ম পালন না করার অপরাধে সেই মোদিকে দল থেকে তাড়াতে বাজপেয়ী যখন আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন, আদভানিই তখন প্রবল বাধা দিয়েছিলেন। আজ মোদির রাস্তায় কাঁটা বিছানোই আদভানির একমাত্র লক্ষ্য। কারণ, ৮৬ বছরের ‘লৌহপুরুষ’ মনে করেন, এ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা আজকের বিজেপিতে তাঁরই জন্মগত অধিকার।

       অর্থাৎ কারও পছন্দ হোক না হোক, কেউ চান বা না চান, নরেন্দ্র মোদিই বারবার উঠে আসছেন আলোচনার শীর্ষে। বিজেপি এই প্রশ্নে একেবারে আড়াআড়ি বিভক্ত। শুধু তা-ই নয়, এনডিএর অন্যতম প্রধান শরিক জনতা দল (সংযুক্ত) নেতা বিহার-নরেশ নীতিশ কুমার বহুবার জোট ত্যাগের হুমকিও দিয়ে রেখেছেন। তবু মোদি তাঁর লক্ষ্যে অটল। বরং সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে গুজরাটে কংগ্রেসের দুরমুশ হওয়া ও লালু প্রসাদের কাছে নীতিশের হেরে যাওয়া মোদির পালে বাড়তি বাতাস জুগিয়েছে। তিনি আরও আশাবাদী হয়ে তাল ঠুকতে তৈরি।

সব মিলিয়ে রাজনীতিটা হয়ে গেছে মোদিময়। কারণ, কংগ্রেসও তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে রয়েছে বিজেপির মোদি-সিদ্ধান্তের দিকে। আশ্চর্যের কথা এটাই।

আশ্চর্য এ কারণে যে, দুর্নীতির অভিযোগ ও প্রশাসনিক অচলাবস্থায় বিপর্যস্ত কংগ্রেস এক-দেড় বছর ধরে প্রায় জড়ভরত হয়ে পড়েছে। কোনো কিছুই ঠিকঠাক কাজ করছে না। অর্থনীতি নিম্নগামী, মনোমোহিনী যাবতীয় দাওয়াই ব্যর্থ। সংস্কারের রাস্তায় হাঁটার উপায়ও নেই শরিকদের অসহযোগিতায়। বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে। মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার সাধারণ মানুষ। কোষাগার ঘাটতি ও কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ডেফিসিট অবর্ণনীয়। সবার ওপরে বিরোধীদের লাগামহীন প্রচার ও আন্দোলন। কংগ্রেসের হাল অনেকটা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’র মতো। কর্ণাটকের জয় যে নিছকই বিজেপির বদান্যতা, কারও কোনো কৃতিত্ব নেই, বি এস ইয়েদুরাপ্পা দল না ছাড়লে বিজেপিই যে আবার ক্ষমতায় আসতে পারত, সাম্প্রতিক উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের পর তা অনুধাবন করা হচ্ছে। এই অবস্থায় মোদিই হয়ে উঠতে পারেন কংগ্রেসের মুশকিল আসান।      

এ এক অদ্ভুত প্রত্যাশা ও সমীকরণ। রাজনীতিতে ভাবমূর্তিই প্রথম ও শেষ কথা। ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রধান গ্রহণযোগ্যতা তার ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি। আর বিজেপির ভাবমূর্তি তাকে বর্ণিত ও চিহ্নিত করেছে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে। বিব্রত, বিপর্যস্ত, সমর্থন খোয়ানো কংগ্রেসের এক বড় অংশ মনে করছে, এই অবস্থায় মোদি যদি হয়ে ওঠেন বিজেপির স্বীকৃত অথবা স্বঘোষিত মুখ, কংগ্রেসের কাছে সেটাই তাহলে হয়ে দাঁড়াবে তুরুপের তাস। মোদির বিজেপিকে ঠেকাতে আর্যাবর্তে সংখ্যালঘু সমর্থনে ঢেউ নামবে। গড়ে উঠবে নতুন সমীকরণ। কংগ্রেস আবার হয়ে উঠবে প্রাসঙ্গিক। 

এই ব্যাখ্যা অবশ্যই সর্বজনগ্রাহ্য নয়। রাজনৈতিক চর্চায় ১৯৯৬-১৯৯৮ সালের সম্ভাবনাও প্রবলভাবে উঠে আসছে। অর্থাৎ, অ-কংগ্রেসি অ-বিজেপি মিলিজুলি তৃতীয় ফ্রন্টের অপলকা সরকার। সম্ভাবনা যা-ই হোক, নির্বাচনী ফলাফলে যে ছবিই আঁকা হোক না কেন, সত্য হলো, বেশ কিছু বছর পর ভারতীয় সংসদের নির্বাচনে আবার এক ব্যক্তিই সম্ভবত হতে চলেছেন আগ্রহ ও আকর্ষণের মধ্যমণি—নরেন্দ্র মোদি।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লিপ্রতিনিধি।