সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ সব সময়ই দুঃসংবাদ। মিসরে ১৯৫২ থেকে সেনাবাহিনীই নির্ধারক শক্তি। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসির উচ্ছেদকে ক্যু বলা যায় না; কারণ, কেউ নিজের বিরুদ্ধে ক্যু করে না। মিসরে সেনাবাহিনী কেবল শাসনের কৌশলটা বদলেছে। অল্প সময়ের জন্য সেনাবাহিনী মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাষ্ট্রীয় কিছু সিদ্ধান্ত নিতে দিয়েছিল। যেই তারা বুঝল যে এ রকম চলতে থাকলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হয়ে ব্রাদারহুডের ক্ষমতা বাড়বে, সেই জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ভাবলেন, যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়। এবং সেনাবাহিনীর ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নির্মম কর্মকাণ্ড চালালেন।
সাধারণত সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ তীব্র জাতীয়তাবাদী এবং খুবই কর্তৃত্ববাদী হয়ে থাকে। সাধারণভাবে তাদের শাসন হয় রক্ষণশীল। কিন্তু সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণ কি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রগতিশীল হতে পারে না? হতেই পারে। কখনো কখনো সেনাবাহিনীর জাতীয়তাবাদ তাদের আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং দেশীয় ক্ষেত্রে বঞ্চিত শ্রেণীগুলোর পক্ষে নিয়ে আসে। ১৯৫২ সালে মিসরে গামাল আবদেল নাসেরের প্রথম ভূমিকা এ রকমই ছিল। কিন্তু প্রগতিশীলতা ও জনমুখিনতা সেনাবাহিনীর স্বভাবের সঙ্গে যায় না। তারা দেশের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় ক্লান্ত বোধ করে। পাশাপাশি তাদের প্রগতিবাদী জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তারা প্রতিবেশীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। সে কারণে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তারা শেষ পর্যন্ত প্রগতিশীল থাকতে পারে না। নাসের ও নেপোলিয়নের বেলায় এটা সত্যি হয়েছিল।
মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর মিসরীয় সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের বিশেষ দিক হলো, দেশে ও বাইরে এর প্রতিক্রিয়ার ধরন। ২০১১ সালে হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হলে মুসলিম ব্রাদারহুড মোবারকের সঙ্গে, অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিলে সমর্থ হয়। সেনাবাহিনী, না মুসলিম ব্রাদারহুড—কেউই তাহরিরে জনতার উত্থানের পক্ষে ছিল না। কিন্তু যেই ঢল নামল, সেই তারা তড়িঘড়ি করে একে গিলে খাওয়ার জন্য মোবারকবিরোধী হয়ে উঠল। এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াই যখন মোবারকপন্থী বনাম ব্রাদারহুডপন্থী হয়ে উঠল, সেনাবাহিনী, বামপন্থী ও সেক্যুলাররা বাধ্য হয়ে মুরসিকেই সমর্থন দিল।
মুরসি যখন ক্ষমতাসীন হয়ে মুসলিম ঝোঁকসম্পন্ন সংবিধান কার্যকর করতে নামলেন, সেক্যুলার ভোটাররা আবার জড়ো হলো তাহরিরে; তারা মুরসিকে নিন্দা জানাল। পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিতে সেনাবাহিনী আবারও তাহরিরকে সমর্থনের কৌশল নিল। আর সেক্যুলার ভোটাররাও দুই বছর আগে যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, এখন তাদের পক্ষেই জিন্দাবাদ দিতে থাকল। মিসরের বাম, সেক্যুলার ও মধ্যপন্থী মধ্যবিত্তদের ভোট এতই কম যে, তাদের কোনো এক পক্ষে চলে না গিয়ে উপায় ছিল না। তারা চলে গেল সেনাবাহিনীর পক্ষে।
বিশ্বে সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের সমর্থক কম নয়: ইসরায়েল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, রাশিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো এবং সম্ভবত বাশার আল-আসাদ। আর বিপক্ষে ছিল হামাস, তিউনিসিয়ার এনহাদা, তুরস্ক ও কাতার। আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা হলো (পশ্চিম ইউরোপেরও তাই) যে-ই জিতুক, যুক্তরাষ্ট্রের তাতেই হার। আমেরিকা এভাবে মিসরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়াল।
ইসরায়েলের কাছে মুরসির চেয়ে সেনাবাহিনীই বেশি পছন্দের। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় হুমকি ব্রাদারহুড। বাশার আল-আসাদ দেখছেন যে ব্রাদারহুড বিদ্রোহীদের বিরাট সমর্থক। আলজেরিয়া আর মরক্কোকে তাদের দেশের ইসলামপন্থীদের সামলাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে; তাই মুরসির পতনে তারা দারুণ খুশি। রাশিয়া হিসাব কষছে, মুরসির পতনে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে বড় কোনো অদল-বদল ঘটছে না, অতএব তারাও খুশি।
তুরস্কের চোখে (তিউনিসিয়ার এনহাদার বেলায়ও) মুরসির পতন মানে ‘মধ্যপন্থী’ মুসলিম সরকারের ধারণার পরাজয়। আর কাতারের জন্য মুরসির পরাজয় মানে সৌদি আরবের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তাদের হাত কমজোরি হয়ে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্র সবকিছুর ওপরে ওই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা চায়। দরকার হলে তারা মুরসির সঙ্গেও কাজ করতে রাজি ছিল। আবার মিসরীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গেও রয়েছে তাদের পুরোনো দোস্তালি। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টাও করেছে তারা। এতে করে দুই পক্ষই অখুশি হয়েছে, আরও চটে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের নব্য রক্ষণশীল গোষ্ঠী এবং মানবাধিকারকর্মীরা।
এদিকে আমেরিকার দেওয়া সামরিক সহায়তার অর্থ মিসরের না হলেও চলবে। কারণ, তার থেকে বেশি টাকা দিচ্ছে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। মিসরীয় সেনাবাহিনী চায় যুক্তরাষ্ট্র থেকেই অস্ত্র ও সরঞ্জাম কিনতে। কিন্তু যদি সাহায্য বন্ধ হয়, তাহলে তারা অন্য জায়গা থেকে সেগুলো সংগ্রহ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের মিসরীয় সেনাবাহিনীকে প্রয়োজন, সে দেশ দিয়ে বিমান উড্ডয়ন, গোয়েন্দা সহযোগিতা, ইসরায়েলের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং আরও এমন এমন বিষয়ের জন্য, যার কোনো অন্য বিকল্প নেই। তাই ওবামাকে মিসরের বিষয়ে বাৎচিতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয়েছে।
মিসরে ডানপন্থীরাই শেষ পর্যন্ত জিতেছে, আর হেরেছে বামপন্থীরা (হয়তো এখনো তারা এই সত্যটা উপলব্ধি করতে পারেনি)। আর নিষিদ্ধ হওয়ার পর মুসলিম ব্রাদারহুড চলে যাবে গোপন রাজনীতিতে, যেখান থেকে তারা আবার ফিরে আসবে আরও শক্তিশালী হয়ে।
গ্লোবাল এজেন্সে থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
ইম্মানুয়েল ওয়ালারস্টেইন: মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী ও বিশ্বব্যবস্থা বিশ্লেষক।