পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে ভারতের কুদানকুলমের কেন্দ্রটি। ওই কেন্দ্রও তৈরি হয়েছে রাশিয়ার ঋণ ও যন্ত্রপাতি দিয়ে। কিন্তু কেন্দ্রটিতে রাশিয়ার সরবরাহ করা যন্ত্রপাতি নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
বিষয়টি নিয়ে ভারতে এবং অন্য যেসব দেশে রাশিয়ার যন্ত্রপাতি দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে বা প্রক্রিয়াধীন আছে, সেসব দেশে বিপুল শোরগোল চলছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ, ভারতের গণমাধ্যম ও সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ওয়েবসাইটে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
রাশিয়ার সহায়তা ও তাদের সরবরাহ করা যন্ত্রপাতি দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রক্রিয়াধীন থাকায় বাংলাদেশও এই শোরগোলের বাইরে নেই। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) বিজ্ঞানীরা প্রকাশ্যে কিছু বলতে রাজি হননি। শুধু বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরাও চিন্তিত।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় পরমাণুবিজ্ঞানী ও গবেষকদের একটি পরিদর্শন প্রতিবেদনে কুদানকুলম কেন্দ্রে নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি সরবরাহের বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর রুশ সরকার এসব যন্ত্রপাতি সরবরাহের সঙ্গে জড়িত তাদের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে।
রাশিয়ার সরবরাহ করা এসব নিম্নমানের ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি স্থাপনের আগে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার করপোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এ প্রশ্নও উঠেছে, তারা যন্ত্রপাতির মান ও ত্রুটি চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, নাকি এড়িয়ে গেছে।
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের তিরুনেলভেলি জেলার সমুদ্র-তীরবর্তী স্থান কুদানকুলম। ভুবনবিখ্যাত পর্যটন এলাকা কন্যাকুমারিকা থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরবর্তী ওই স্থানে কেন্দ্রটি স্থাপনের বিষয়ে ভারত-রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয় ১৯৮৮ সালে। ২০০১ সালে কাজ শুরু হয়। এক হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার (ভিভিইআর-১০০০) কেন্দ্রটি ২০১২ সালে চালু হওয়ার কথা ছিল। তার আগেই উল্লিখিত ঘটনা প্রকাশিত হয়।
কুদানকুলমের আগেও ভারতে একাধিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সেগুলো চালুও আছে। এ ব্যাপারে প্রতিটি স্থানেই স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবাদীদের বিরোধিতা ছিল। কুদানকুলমেও ছিল।
কিন্তু এনপিসিআইএল অত্যন্ত জোর দিয়ে বলতে থাকে, কেন্দ্রটি নির্মাণে সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে, তার প্রতিটি কয়েক দফা মান পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু তাতেও জনপ্রতিরোধ না কমলে বিষয়টি উচ্চ আদালতে গড়ায়। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চের ২৪৭ পৃষ্ঠার রায়ে স্থানীয় জনগণের ভীতির কারণ ও অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু একদল ভারতীয় বিজ্ঞানী ও গবেষক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিদর্শন করে উদ্ঘাটন করেন, কেন্দ্রটিতে নিম্নমানের সামগ্রী ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হয়েছে। এই পরিদর্শনের পর বিশিষ্ট ভারতীয় বিজ্ঞানী ও গবেষক ভি টি পদ্মনাভন ‘স্ক্যান্ডালস ইন দ্য নিউক্লিয়ার বিজনেস’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে সবার দৃষ্টি ঘুরে যায়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হূৎপিণ্ড হচ্ছে রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল (আরপিভি)। কুদানকুলম কেন্দ্রের সেই আরপিভি তৈরি করা হয়েছে তিন দশকের পুরোনো ও বাতিল নকশার ভিত্তিতে। জিও পডোলস্ক নামের একটি রুশ কোম্পানির সরবরাহ করা অনেকগুলো যন্ত্রপাতি বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ব্যবহার করা হয়েছে, যা ত্রুটিপূর্ণ।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর রুশ ফেডারেল প্রসিকিউটর জিও পডোলসেকর পরিচালক (ক্রয়) সের্গেই সুতভকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি বুলগেরিয়া, ইরান, চীন ও ভারতে রাশিয়ার নির্মাণাধীন পারমাণবিক স্থাপনার যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য নিম্নমানের ইস্পাত কিনেছেন।
এদিকে ভারতের ৬০ জন বিজ্ঞানী তামিলনাড়ু ও কেরালার দুই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে পুরো বিষয়টি জানান। নয়াদিল্লিভিত্তিক ‘কোয়ালিশন ফর নিউক্লিয়ার ডিসার্মামেন্ট অ্যান্ড পিস’ একে অভিহিত করে ভারতের ‘অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি বোর্ডের (এইআরবি)’ নিরাপত্তা বিধিমালার সরাসরি লঙ্ঘন বলে।
এরপর এইআরবি গত এপ্রিল মাসে অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিত্তিতে ঘোষণা করে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির চারটি ভাল্ব ত্রুটিপূর্ণ। তারা এনপিসিআইএলকে নির্দেশ দেয় ভাল্বগুলো প্রতিস্থাপন করে সেগুলো পরীক্ষা করার জন্য তাদের হাতে ছেড়ে দিতে।
এইআরবির সাবেক চেয়ারম্যান এ গোপালাকৃষ্ণান দুর্নীতি ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভিযোগ যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা এবং ব্যবহূত যন্ত্রপাতির মান ও ত্রুটিমুক্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি বন্ধ রাখতে সরকারের কাছে আহ্বান জানান।
এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার পরমাণু শক্তি করপোরেশন—রোস্যটম কুদানকুলম কেন্দ্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা উন্নত করতে নতুন একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দাবি করেছে। তাদের দাবি, ‘ফাস্ট-অ্যাকটিং বোরন ইনজেকশন (পিএফআইবিআইএস)’ করে আণবিক চুল্লির প্রাথমিক শীতলীকরণ সার্কিটে বরিক অ্যাসিডের ঘন দ্রবণ ঢুকিয়ে চুল্লির কার্যক্ষমতা ‘সাব-ক্রিটিক্যাল’ পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাবে। ভিভিইআর-১০০০ চুল্লিতে এই পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে চুল্লিগুলোর নিরাপত্তানির্ভরতা অনেকটাই বাড়বে বলে তাদের দাবি। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে তারা মেনে নিয়েছে যে ভিভিইআর-১০০০ চুল্লিতে, বিশেষ করে কুদানকুলমে সরবরাহ করা চুল্লিটিতে সমস্যা আছে। বিশ্বব্যাপী ভিভিইআর-১০০০ চুল্লি সম্পর্কে সমালোচনা তুঙ্গে। এর নিরাপত্তানির্ভরতা সর্বাধুনিক নয়। কুদানকুলমের মতো রূপপুরেও এই চুল্লি ব্যবহার করা হবে।
এ প্রসঙ্গে বিএইসির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মতিনের অভিমত, ‘অতি উচ্চ দাম ও উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরে ত্রুটি থাকা এবং ত্রুটিপূর্ণ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ঘটনা বিরল। ভারতের বিজ্ঞানীরা তবু ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি সরবরাহের বিষয়টি ধরতে পেরেছেন। আমাদের দেশে এটা ধরার মতো লোকেরও অভাব আছে।’
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো বিপুল ব্যয়ের প্রকল্পে দুর্নীতি অস্বাভাবিক হলেও অসম্ভব নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে। কারণ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার অবস্থান প্রায় সমান। তাই দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। নিরাপত্তার বিষয়টিকেও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।
অরুণ কর্মকার: সাংবাদিক।