ভারতে করোনায় মৃত্যু, মিথ্যা বলেনি গঙ্গা

প্রায় দেড় বছর ধরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বিশ্ব। এই মহামারির সবচেয়ে মর্মন্তুদ চিত্রগুলোর একটি দেখা গেছে প্রতিবেশী দেশ ভারতে। গত এপ্রিল ও মে মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশটির বেশ কয়েকটি রাজ্য। মুমূর্ষুদের জীবনরক্ষায় জরুরি অক্সিজেনের জন্য আকুতি জানিয়ে দেওয়া পোস্টে ভরে ওঠে ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। এ সময় কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতে প্রতিদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বিশ্বে নতুন রেকর্ড গড়ে। রাজধানী দিল্লির শ্মশানগুলোতে দিনরাত চিতা জ্বালিয়েও শেষ করা যায়নি অপেক্ষমাণ লাশের সারি। মৃতদেহ সৎকারে শ্মশানগুলো বড় করার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্মশান গড়ে তোলা হয়। এই পরিস্থিতি চলার মধ্যেই গঙ্গায় ভেসে আসতে থাকে শত শত মৃতদেহ। এ ধরনের জরুরি জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে যে ধরনের সক্ষমতা তৈরি করতে হয়, সেখানে ভারত সরকারের ঘাটতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন দেশটির জাতীয় দৈনিক ভাস্কর-এর সম্পাদক ওম কাউর। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউইয়র্ক টাইমস-এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে।

ভারতে গত এপ্রিল ও মে মাসে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত হাজারো মানুষকে গঙ্গার তীরে মাটিচাপা দেওয়া হয়। গত ২১ মে উত্তর প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় শ্রিংভেরপুর এলাকায়।
ছবি: রয়টার্স

ভারতীয়দের কাছে গঙ্গা পবিত্র নদী। অধিকাংশ হিন্দু বিশ্বাস করেন, এই নদীতে তাঁদের মৃতদেহ ডুবিয়ে দেওয়া হলে আত্মা শুদ্ধ হবে। কিন্তু এই বসন্তে যখন করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হলো, এই নদী হয়ে উঠল মোদি প্রশাসনের ব্যর্থতা ও ধোঁকাবাজি প্রকাশের বড় মাধ্যম।

উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য বিহার গত এপ্রিল ও মে মাসে করোনায় মৃত্যুর হিসাব সংশোধন করে ৫ হাজার ৪২৪ জন থেকে বাড়িয়ে ৯ হাজার ৩৭৫ জন করেছে। ভারতের উত্তরাঞ্চলে এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব কুম্ভমেলায় ১০ লাখের মতো মানুষের সমাগম ঘটে। ওই মেলা দেশটিতে করোনাভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম উৎস হয়ে ওঠে। এখন খবর বেরিয়েছে, সেখানে করোনাভাইরাস পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো প্রায় এক লাখ ভুয়া প্রতিবেদন দিয়েছিল।

ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব কমে এসেছে। কিন্তু দেশটি এখনো মৃত্যুর হিসাব নিয়ে ধুঁকছে। দেশটিতে করোনায় প্রায় ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যার বড় অংশই ঘটেছে গত মার্চের পর থেকে। তবে এ সময় প্রকৃত অর্থে কত মৃত্যু হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার উভয়ই বিভ্রান্তিতে রয়েছে। কিন্তু পবিত্র গঙ্গা মিথ্যা বলেনি।

গঙ্গার ৭০০ মাইলে ২ হাজার লাশ

১২ মে বিহারের বক্সার জেলার গ্রামবাসী নদীতে লাশ ভাসতে দেখেন। ওই এলাকা এবং উজানের ঘাজিপুরে শ খানেক মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্থানীয় একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশ থেকে লাশগুলো নদীতে ভেসে ভাটিতে এসেছে।

আমি ভারতের জাতীয় দৈনিক ভাস্কর-এর সম্পাদক। প্রতিদিন ভারতজুড়ে হিন্দি ভাষার এই পত্রিকার প্রায় ৫৫ লাখ কপি বিক্রি হয়। পাঠকদের অধিকাংশই ছোট শহর ও গ্রামের বাসিন্দা। পাঠকদের মহামারির ধ্বংসযজ্ঞের একটি স্পষ্ট চিত্র দেওয়ার জন্য আমরা ৩০ জন প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী পাঠিয়েছিলাম উত্তর প্রদেশের প্রধান শহর ও জেলাগুলোতে গঙ্গার তীর ঘুরে দেখার জন্য।

আমাদের প্রতিবেদকেরা শুধু ১২ ও ১৩ মে এই নদীর পাড় ধরে ৭০০ মাইল ঘুরে ২ হাজার মৃতদেহের খোঁজ পান। লাশগুলো শুধু নদীতে ভাসছিল না, ৬৫ থেকে ৭০টি তীরে ভেসে এসেছিল। এখন পর্যন্ত রাজ্য সরকারের দাবিমতে, ১ এপ্রিল থেকে ১৩ মে পর্যন্ত মাত্র ৭ হাজার ৮২৬ জন মানুষ কোভিড-১৯-এ মারা গেছেন।

সংখ্যায় সংক্রমণ-মৃত্যু • ভারতে করোনার সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় বাড়তে শুরু করে গত মার্চের মাঝামাঝিতে। • দৈনিক শনাক্ত রোগী ২০ হাজারের ঘর থেকে দুই সপ্তাহের মাথায় লাখে পৌঁছায়। • রেকর্ড সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয় ৬ মে, ৪ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৩ জন। • দৈনিক মৃত্যু এক শর ঘর থেকে মাসখানেকের মধ্যে উঠে যায় হাজারে। • এক দিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ২৩ মে, ৪ হাজার ৮৯৬ জন। • এখন দৈনিক রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু দুটিই কমে এসেছে। তথ্যসূত্র: ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফো

বৃষ্টিই সামনে আনল ট্র্যাজেডির একাংশ

উত্তর প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ছোট গ্রাম শ্রিংভেরপুর হিন্দুদের কাছে পবিত্র এলাকা হিসেবে বিবেচিত। হিন্দু দেবতা ও রামায়ণের নায়ক চরিত্র রাম-এর সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এই গ্রামের সঙ্গে। আমাদের প্রতিবেদকেরা দেখতে পান, অল্প জায়গায় অনেক মৃতদেহ মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। শত শত মৃতদেহ মুড়িয়ে রাখা কাপড় মাটি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। দরিদ্র গ্রামবাসী স্বজনদের দাহ করার জন্য কাঠ কিনতে না পেরে একটি পবিত্র স্থানে তাঁদের মাটিচাপা দিয়ে সান্ত্বনা খোঁজেন।

আরও প্রতিবেদন আসার পর আমাদের ধারণা হয়, মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে মাসের মধ্যে নদীর তীরে এক মাইলের কম জায়গায় ৪ হাজারের বেশি মৃতদেহ কবর দেওয়া হয়েছে।

আমরা হয়তো কখনোই এই ট্র্যাজেডি সম্পর্কে জানতে পারতাম না। কিন্তু মে মাসের প্রথম দিকে বৃষ্টিতে গঙ্গায় পানি বেড়ে তীরবর্তী এলাকা প্লাবিত হয়। এর ফলে নদীর তীরে মাটিচাপা দেওয়া মৃতদেহগুলো নদীতে ভেসে আসতে শুরু করে।

যোগীর অস্বীকার আর হুমকি

এই বৃষ্টি গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা জোরদার এবং পর্যাপ্ত টিকার সরবরাহ নিশ্চিতে সরকারের বড় ধরনের ব্যর্থতাও প্রকাশ করে দেয়।

২০০৭ সাল থেকে উত্তর প্রদেশের শাসনক্ষমতায় রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি। হিন্দু সন্ন্যাসী থেকে রাজনীতিতে আসা যোগী আদিত্যনাথ এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। গত এপ্রিলে রাজ্যজুড়ে ভয়াবহ অক্সিজেন সংকটের পাশাপাশি ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ শয্যার ঘাটতি দেখা দেয়। সে সময় শ্মশানগুলোতেও ভিড় লেগে থাকে। এসব খবর অস্বীকার করেন মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ। এগুলোকে অস্বীকার করে হুমকি দেন তিনি। এগুলোকে গুজব আখ্যা দিয়ে তিনি রাজ্যের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, এসব ছড়ালে নাগরিকদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলার পাশাপাশি তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে।

উত্তর প্রদেশ সরকার শুধু হাসপাতালে মারা যাওয়া ব্যক্তিদেরই মৃতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু গ্রামের বহু মানুষ, যাঁদের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত, তাঁরা মারা যাচ্ছিলেন বাড়িতেই।

ঘাজিপুরের রিওতিপুর শহরে প্রায় ৭০ হাজার মানুষের বসবাস। সেখানে চিকিৎসক মাত্র একজন। মে মাসের মাঝামাঝিতে ওই চিকিৎসক আমাদের একজন প্রতিবেদককে বলেছিলেন, প্রায় ৮৫০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সেখানকার কিছু বাসিন্দা প্রতিবেদককে বলেন, শুধু এপ্রিলেই প্রায় ২০০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা

কোভিড-১৯-এ পরিবারের তিনজনকে হারানো মাহেন্দ্রনাথ উপাধ্যায় আমাদের প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। দুটো খাবারের সংস্থান করাই আমাদের জন্য দুষ্কর। সেখানে চিকিৎসার জন্য আমাদের টাকা নেই।’

গ্রামীণ দারিদ্র্য করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবকে আরও ভয়াবহ করেছে। কিন্তু তা স্বীকার করতে চায় না মোদি সরকার। তাদের ওই অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বসন্তেই বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ কুম্ভমেলার অনুমতি দিয়েছে। পাশাপাশি উত্তর প্রদেশসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যে নির্বাচন করা হয়েছে।

এখন পর্যন্ত দেশের জনগণের মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ পুরোপুরি টিকার আওতায় এসেছে। তাই আবারও আরেকটি ধ্বংসাত্মক করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করার পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য লড়েছিলেন, সে সময় উত্তর প্রদেশের গঙ্গার তীরবর্তী পবিত্র নগরী বারানসি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তিনি। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে, মা গঙ্গা যেন আমায় বারানসিতে ডাকছে।’ আজ গঙ্গা তাঁকে চলে যেতে বলছে।

অনুবাদ: আজিজ হাসান