ভার্চ্যুয়াল কোর্টের কার্যপরিধি বাড়াতে হবে

ভার্চ্যুয়াল কোর্টই সম্ভবত হবে ভবিষ্যতের মূলধারার কোর্ট। অনেকেই ভাবছেন, কোভিড-১৯ আসার কারণেই হয়তো বিশ্বের দেশে দেশে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট বিস্তার লাভ করেছে। এটা খণ্ডিত ধারণা। ব্রিটিশ অধ্যাপক রিচার্ড সাসকিন্ডের মতো অনেকেই ভার্চ্যুয়াল কোর্ট নিয়ে বহু বছর ধরে সক্রিয়। সাসকিন্ড তাঁর অনলাইন কোর্টস অ্যান্ড দ্য ফিউচার অব জাস্টিস বইয়ে প্রশ্ন রেখেছেন, আদালত কি একটি স্থানের নাম নাকি এটি একটি সার্ভিস বা সেবা? এ ব্যাপারে একমত হতেই হবে যে এটি কোনোভাবেই স্থানসর্বস্ব নয়, এটা সেবা।

চীনা সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালেই প্রথম স্মার্ট কোর্ট কথাটি ব্যবহার করেছেন। উহান-কাণ্ডের আগেই স্মার্ট কোর্টের ডিজিটাল মহাফেজখানায় জমা পড়া রায় ও নথির সংখ্যা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। সাসকিন্ড বর্তমানে ইংল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির প্রধান প্রযুক্তি উপদেষ্টা। তিনি রিমোট কোর্টস ওয়ার্ল্ডওয়াইড নামে একটি ওয়েবসাইট খুলেছেন। ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় করোনাকাল শুরুর আগেই তিনি বিশ্বের ২২টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে আন্তর্জাতিক ভার্চ্যুয়াল কোর্ট সম্মেলন করেছেন। ওই ওয়েবসাইটে মামলায় ভারাক্রান্ত বিশ্বের ৫৫টি দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ তার অন্যতম।

করোনা–পরবর্তী বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বিচার বিভাগকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তাই এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে স্মার্ট কোর্ট আদতে একটা অসম্ভব ব্যাপার। বাংলাদেশের অনেকেই মনে করছেন, আপাতত এটা চলছে, চলুক। অতিমারি বিদায় নিলেই আমরা ওকে বিদায় দেব। উন্নত দেশে ওই সব চললে চলতে পারে। অবশ্য কেউ বলছেন, আমেরিকান সুপ্রিম কোর্টই যেখানে ইতিহাসে এই প্রথম ভার্চ্যুয়াল হিয়ারিং শুরু করেছেন, সেদিক থেকে দেখলে বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। আসলে আমেরিকার বহু অঙ্গরাজ্যে অনলাইন আদালত বিস্তৃত হচ্ছিল। বাকি ছিল শুধু কেন্দ্রীয় সুপ্রিম কোর্টে পূর্ণাঙ্গ শুনানি। তারা কতটা প্রস্তুত ছিল, সেটা একজন সহযোগী বিচারপতির কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘আমরা আর কখনো পুরোপুরি সেকেলে শুনানিতে যাব না। ভারতের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবদেও বলেছেন, আর পিছু ফেরা নয়। ভবিষ্যতে পুরোনো ও নতুনের সমন্বয় চলবে।’

আসল কথা হলো, উন্নত বিশ্ব বলেই নয়। আয়তনে ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ এবং কম সম্পদের রাষ্ট্র কী দেখাতে পারে, সেটাই আসল কথা। করোনাকালে বাংলাদেশে ভার্চ্যুয়াল আদালত কাজ করছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মামলাজটে নাকাল বাংলাদেশ কী করবে? স্মার্ট কোর্ট তাকে একটা মুক্তি দিতে পারে। জানি দোনোমনা থাকবেই। কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারলেই সেটা সম্ভব হতে পারে।

ভার্চ্যুয়াল আদালতের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিভিতুদের প্রবল বিরোধিতা ছিলই। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি একটি জুডিশিয়াল স্টেটসম্যানশিপ দেখাতে পেরেছেন। এখন আইনজীবীদের যে অংশটি নিয়মিত কোর্ট খুলতে সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গনে কয়েক দিন ধরে স্লোগান দিচ্ছেন (তাঁদের ব্যানারে লেখা: আমরা ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চাই না), তাঁদের অনেককেই আমরা ভার্চ্যুয়াল কোর্টের বিরোধিতা করতে দেখেছি। লকডাউনের মধ্যেও যাতে সাংবিধানিক আদালত মূর্ত ও সচল থাকে, সে জন্য প্রধান বিচারপতি একটি বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে দুটি একক করোনা বেঞ্চ গঠন করেছিলেন। কিন্তু তখন উল্লিখিতদের প্রচণ্ড বিরোধিতা করতে দেখেছি। সংবিধান টিকল কি টিকল না, সেটা যেন তাঁদের বিবেচনার মধ্যেই নেই। জরুরি অবস্থা জারি হলেও শুধু ছয়টি অনুচ্ছেদ স্থগিত করা চলে। সংবিধানের পুরো চ্যাপ্টারের কার্যকারিতা স্থগিত করার অধিকার যুদ্ধকালেও কারও নেই।

আদালত পুরো বন্ধ করার ওই সময়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। করোনা বেঞ্চের পক্ষে কথা বলায় কেউ কেউ রাগও করলেন। জীবন বড়, স্বার্থের দ্বন্দ্বও কম বড় করে দেখা হয়নি। কারণ বলা হয়েছে, প্রতিদিন অল্প কয়েকজন শুনানির সুযোগ পাবেন, বেশির ভাগই পাবেন না। তাই বন্ধই থাক। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বিশ্বের সম্ভবত একমাত্র কোর্ট, যাঁরা করোনায় কয়েক সপ্তাহ দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন।

এটা আসলে প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রশ্ন। আমরা কেউ অফিসে আসব না। সবাই বাসায় থাকব। কিন্তু রোজ পত্রিকা বেরোবে। এটা সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে। করোনা আমাদের প্রযুক্তিগতভাবে যোগ্য করে তুলেছে। তাই স্মার্ট কোর্ট চালু রাখা একটা অভ্যাস ও মনস্তত্ত্বের দ্বৈরথ। স্মার্ট কোর্টবিরোধীরা তো কম স্মার্ট নন। কারণ, তাঁরা স্মার্ট কোর্টের বিরোধিতা করেন ফেসবুকে, স্মার্ট ফোনে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচিত জ্যেষ্ঠ নেতাকে বললাম, দুনিয়ার কোথায় কী ঘটছে, আর আমরা কোথায়। তিনি স্বীকার করলেন, প্রযুক্তিভীতিই মুখ্য বাধা। সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ও সম্পাদক, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে দুই বিপরীত মেরুর, তাঁরা করোনা বেঞ্চ গঠনে প্রধান বিচারপতির সমর্থক ছিলেন। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের’ আবেগের মুখে তাঁরাও বিব্রত হলেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু এ প্রসঙ্গে দৃঢ়তার সঙ্গে একটি লাতিন প্রবাদ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘লেট জাস্টিস বি ডান দো দ্য হ্যাভেনস ফল’। স্বর্গ ভেঙে পড়ুক, বিচার দিতে হবে।

বাংলাদেশে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চলার দুই মাস হতে চলল। কিন্তু এখনো এটা প্রধানত জামিন শুনানির মধ্যে সীমিত রয়ে গেছে। এটাই আমাদের বড় উদ্বেগের বিষয়। এখন যেভাবে কোর্ট চলছে, তার কার্যপরিধি বাড়ানো সময়ের দাবি।

প্রথমত, করোনাকালে মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার জন্য বড় আশ্রয় সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ। এর আওতায় রুল জারি করতে হলে দুজন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন (দ্বৈত) বেঞ্চ দরকার। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট রুল জারি করতে পারছেন না। কারণ, বর্তমানে হাইকোর্টের কোনো ডিভিশন বেঞ্চ নেই। সবই তাই চলছে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে। সেই প্রতিকারও অস্থায়ী, তাঁরা চাইলেও পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে পারছেন না। কার্যপরিধি বাড়ালেই এর সুরাহা সম্ভব।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জামিনেই সীমিত থাকেননি। তাঁদের ৮৭টি বেঞ্চ করোনাকালের এক মাসে ৫৯৩টি মামলা শুনেছেন, ২১৫টিতে রায় দিয়েছেন। সুতরাং এটা যুক্তিসিদ্ধ যে দিল্লিতে যদি ভার্চ্যুয়াল বিচারে চূড়ান্ত রায় হতে পারে, ঢাকাতে হতে সমস্যা কোথায়?

দ্বিতীয়ত, বর্তমানে যে ভার্চ্যুয়াল শুনানি হচ্ছে, সেটা শুধু আইনজীবী ও বিচারকদের মধ্যে সীমিত থাকছে। ক্যামেরা ট্রায়ালেও শুধু বার ও বেঞ্চ থাকে। অথচ বিশ্বের বহু দেশে শুনানি লাইভ চলছে। কেরালা সঠিকভাবে করোনা মোকাবিলা করেই নাম করেনি। তারা তাদের হাইকোর্টসহ সব আদালতের শুনানি লাইভ স্ট্রিমিং করছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ বলেছে, বিচার হবে প্রকাশ্যে, ৩৯ অনুচ্ছেদ ও তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী, স্মার্ট কোর্টেও সাংবাদিকের প্রবেশাধিকার রয়েছে। ১০৬ অনুচ্ছেদ বলছে, সুপ্রিম কোর্ট হবেন অনাদিকালের স্থায়ী কোর্ট অব রেকর্ড, তার মানে নাগরিকেরা দর্শক-শ্রোতা হতে এবং ডিজিটাল রেকর্ড পাওয়ারও অধিকারী।

তৃতীয়ত, আইনজীবী ছাড়াই বিচারপ্রার্থী যাতে নিজের মামলা নিজেই চালাতে পারেন, সেই সুযোগ দেওয়া।

শেরপুরের অধস্তন আদালত ভালো নজির স্থাপন করেছে। শেরপুর বার সভাপতি ভার্চ্যুয়াল কোর্ট বর্জন করতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠদের হাতে–কলমে বোঝাতেই বরফ গলল। শেরপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এ এম হুমায়ুনের নেতৃত্বে ৭ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের একটি দল সেখানে জামিন ছাড়াও গত দেড় মাসে অন্তত ৫০টি বিবিধ মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করেছে।

নিয়মিত আদালত কখন কীভাবে চালু হবে, সেটা বার ও বেঞ্চের আলোচনাসাপেক্ষ। আট হাজারের বেশি আইনজীবীর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত আসেন অন্তত আড়াই হাজার। তাঁদের সহকারী ও বিচারপ্রার্থী মিলিয়ে উপস্থিতি বিরাট। স্থান সংকুলানের অভাবে আইনজীবীরা গাদাগাদি করে বসেন। সুতরাং সরকারি অফিসগুলোর মতো দূরত্ব সেখানে তৈরি করাও কঠিন। ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের অন্তত ১২ জন আইনজীবী এবং একজন কর্মরত জেলা জজ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ২৯ জুন সুপ্রিম কোর্ট মুখপাত্র জানালেন, অধস্তন আদালতের ৩৭ বিচারক, ১০১ জন কর্মচারী এবং সুপ্রিম কোর্টের ৩৮ কর্মচারী এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন।

তবে ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতিতে স্মার্ট কোর্ট মানে প্রধানত জামিনদান বা এটা যে একটা ক্রান্তিকালীন বিষয় নয়, সেটা সবার কাছে পরিষ্কার করতে হবে। সংসদের বিলটিও সেভাবে পাস হতে হবে। নিয়মিত আদালতের পাশাপাশি স্মার্ট কোর্ট যেখানে প্রযোজ্য, সেখানেই চলবে। মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও মানুষের ভোগান্তি কমাতে স্মার্ট কোর্ট অবশ্যই একটি উত্তর। ভারতে বিচারপতি এন ভি রমানার নেতৃত্বাধীন সাত সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতির কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, করোনার পরও ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চলবে। (দ্য হিন্দু, ১৫ জুন)।

এটা উৎসাহব্যঞ্জক যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রী উভয়ে একটি শক্তিশালী ই-জুডিশিয়ারি গঠনে আগ্রহী।

মিজানুর রহমান খানপ্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক