ভালো সাংবাদিকতা দিয়েই আস্থা অর্জন করতে হবে

স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এসব বিষয় নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সোচ্চার হয়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাঁরা মনে করছেন, রাষ্ট্রীয় নানা আইন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে বিএফইউজে–বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল–এর সঙ্গে

মনজুরুল আহসান বুলবুল

প্রশ্ন :

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোজিনা ইসলামকে আটকে রেখে নির্যাতন করে মামলা দিয়েই চুপ থাকেনি, তারাই ঘটনার তদন্ত করছে। মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য দিয়ে জনগণের করের টাকায় বিজ্ঞাপন ছেপেছে। এখন মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুকে সেদিনের ঘটনার খণ্ডিত ভিডিও প্রচারিত হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও অপপ্রচার চলছে। এ পরিস্থিতি নিয়ে কী বলবেন?

মনজুরুল আহসান বুলবুল: রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে এবং বিষয়টি আদালতে আছে। তাই মামলাকে প্রভাবিত করে এমন কোনো কিছু কোনো পক্ষেরই করা ঠিক হবে না। যাঁরা রোজিনার পক্ষে মাঠে ছিলেন, তাঁরা রোজিনার মুক্তিই চেয়েছেন শুধু। তাঁরা সর্বোচ্চ যেটুকু বলেছেন, সেটি হচ্ছে, যে মামলা হয়েছে তা মিথ্যা। কিন্তু রোজিনার বিরুদ্ধে যাঁরা মামলা করলেন, সেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একাধারে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। যেটা তাদের আদালতে করার কথা। তাদের ফেসবুক পেজে কিছু ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। সেগুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমলযোগ্য অপরাধ বলে আমি মনে করি। কারণ, এগুলো খণ্ডিত ভিডিও। এগুলোর দাপ্তরিক সূত্র আমরা জানি না। এটা তো আসলে সাইবার ক্রাইম।

প্রশ্ন :

দেশে তথ্য অধিকার আইন আছে। আবার এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মতো আইনের প্রয়োগ চলছে। এই অবস্থার ব্যাখ্যা দেবেন কীভাবে?


মনজুরুল আহসান বুলবুল: ২০০৯ সালে দেশে তথ্য অধিকার আইন করা হয়েছে। তথ্য উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে এটি একটি প্রগতিশীল আইন। এরপর ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৫০১ ও ৫০২ ধারার মধ্যে সংযোজন হলো, সাংবাদিকদের আর ওয়ারেন্ট দিয়ে গ্রেপ্তার করা যাবে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় ধরনের উন্নয়ন। এ সরকারের আমলেই ২০১১ সালে জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ আইন করা হলো। যেখানে মূল বিষয় হলো, কেউ যদি জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ করে, তবে তাকে সুরক্ষা দেওয়া হবে। তিনটিই খুব অগ্রসরমুখী আইন। এই তিনটি আইনের যে মূল চেতনা, এর বিরোধী কিন্তু অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট। তথ্য অধিকার আইনের সময় আমরা অনুরোধ করেছিলাম, এখন আর অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের প্রয়োজন নেই। কিন্তু তখন আমাদের বলা হয়েছিল, এটা সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য হবে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নয়। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে আমরা সোচ্চার ছিলাম। তখন বলা হয়েছিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এটি থাকবে না। তবে পরে দেখা গেল, এই আইনের বিভিন্ন ধারায় ৫৭ ধারা ছড়িয়ে আছে। অর্থাৎ যে তিনটি প্রগতিশীল আইন করা হয়েছিল, তার চেতনা নষ্ট হয়ে গেল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের মতো আইনের মাধ্যমে।

প্রশ্ন :

বিশ্বে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হচ্ছে।

মনজুরুল আহসান বুলবুল: শুধু আরএসএফ নয়, ফ্রিডম ফোরাম নামে গণমাধ্যমের অধিকার নিয়ে বিশ্বে বড় একটি সংগঠন আছে। তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে ১০ বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আংশিক মুক্ত দেশ। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যখন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি নিরীক্ষা করে, তখন কয়েকটি সূচকের দিকে নজর দেয়। এগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমের আইনগত সুযোগ-সুবিধা, সরকারিভাবে কালাকানুনের প্রয়োগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়া এবং সাংবাদিকতার পরিবেশের বিষয় আছে। আবার রাষ্ট্রীয় এবং অরাষ্ট্রীয় দুই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকাও এখানে বিচার্য হয়। পর্যাপ্ত আইন থাকা বা না থাকার বিষয়টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিষয়। জঙ্গি সংগঠন এবং সমাজের ক্ষমতাশালী শ্রেণির মতো অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের খড়্গও আছে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর। মতপ্রকাশের দুর্বল অবস্থানের জন্য দুই পক্ষের তৎপরতাই ভূমিকা রাখে।

প্রশ্ন :

সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর সাম্প্রতিক আন্দোলনে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য অশনিসংকেত সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে বলেও মনে করছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। আপনার মন্তব্য কী?

মনজুরুল আহসান বুলবুল: গণমাধ্যমের স্বাধীনতার লড়াইটা কিন্তু শুধু সাংবাদিকদের বিষয় নয়। যাঁরা গণমাধ্যম ব্যবহার করেন, তাঁদেরও লড়াই। গণমাধ্যমের সংকটে যদি নাগরিক সমাজ সম্পৃক্ত হয়, তখন সেই আন্দোলন শক্তিশালী হয়। তখনই সাধারণ মানুষ গণমাধ্যমের পক্ষে দাঁড়াবে, যখন গণমাধ্যম তাদের আস্থা অর্জন করবে। এবার রোজিনা ইসলামের ঘটনাটা যদি দেখি, তাঁর একাধিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ তাঁর এসব প্রতিবেদন বিশ্বাস করেছে। মানুষ প্রথম আলোকে বিশ্বাস করেছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, এসব প্রতিবেদন সে আকাঙ্ক্ষার পক্ষে গেছে। মানুষ বলেছে, রোজিনার মতো একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে যদি স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, তবে মানুষের তথ্য জানার অধিকারই বন্ধ হয়। তাই এবার মানুষ মাঠে নেমেছিল। যে আচরণ রোজিনার সঙ্গে করা হলো, তার মাধ্যমে একটি বার্তা দেওয়া হলো। সেটি হলো, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে তুমি এমন বিপদের মধ্যে পড়তে পারো। কিন্তু যারা এই বার্তা দিয়েছে, তারা বুঝতে পেরেছে, একটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বার্তা দিলেও তাদের বিরুদ্ধে এবং গণমাধ্যমের পক্ষে লাখ লাখ মানুষ দাঁড়িয়ে গেছে। যাঁরা ভালো সাংবাদিকতা করতে চান, তাঁদের জন্য শক্তি ও সাহসের জায়গা এটি। অর্থাৎ ভালো সাংবাদিকতা দিয়েই এই আস্থা অর্জন করতে হবে।

প্রশ্ন :

সাংবাদিক নেতারা বলছেন, প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা সরকার ও গণমাধ্যমকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কেন এমন পরিস্থিতি তৈরির সুযোগ পাচ্ছেন কর্মকর্তারা?

মনজুরুল আহসান বুলবুল: হয়তো কিছু ক্ষেত্রে এটা সত্যি। কিন্তু এই আমলারাই যখন ভালো কাজ করেন, এর কৃতিত্ব কিন্তু রাজনৈতিক সরকারই নেয়। তাই কোনো মন্ত্রণালয়ের কোনো আমলা যদি কোনো অন্যায্য কাজ করে থাকেন, তবে সেই মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক ব্যক্তি বা মন্ত্রীকে সেই দায় নিতে হবে। মন্ত্রী যদি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন, তবে কোনো আমলার অসৎ উদ্দেশ্য থাকলেও তা নস্যাৎ হতে বাধ্য। আমলাদের জবাবদিহি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায় দেশের মানুষের কাছে। আমলারা অনেক সময় সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করে। দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্ব আমলাদের অতিরিক্ত ক্ষমতাবান করে ফেলেন। আমি চাই না আমাদের রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল নেতৃত্বের ধারক-বাহক হোক।