ভাষাবিদ জাহাঙ্গীর তারেক

সপরিবারে জাহাঙ্গীর তারেক
সপরিবারে জাহাঙ্গীর তারেক

বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক সৃজনশীল ও মননশীল প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল, যাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ প্রয়াত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ আব্দুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান, মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ প্রমুখ।
ষাটের দশকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক সৃজনশীল ও মননশীল প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন; যাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রয়াত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কবি ও কথাসাহিত্যিক আব্দুল মান্নান সৈয়দ, ভাষাবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ এবং বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট অনুবাদক, তুলনামূলক সাহিত্যবিশারদ জাহাঙ্গীর তারেক। আমাদের এই আলোচনা বহু গুণে গুণান্বিত জাহাঙ্গীর তারেককে নিয়ে। তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে এম এ পাস করার পর বছর পাঁচেক বিভিন্ন বেসরকারি ও সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন।
১৯৬৯ সালে জাহাঙ্গীর তারেক ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে প্যারিস গমন করেন। বস্তুতপক্ষে প্যারিসে জাহাঙ্গীর তারেকের নতুন জীবনের সূচনা হয়, যেখানে তিনি ফরাসিসহ একাধিক বিদেশি ভাষা আয়ত্ত করেন। ফ্রান্সে তিনি প্রথমে ফরাসি ও ইংরেজি সাহিত্যে দুটি এমএ ডিগ্রি এবং তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ফরাসি দেশে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের পর ১৯৭৪ সালে দেশে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং কিছুদিন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে তিনি ফরাসি ভাষার সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন এবং একসময় এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৮ বছর অধ্যাপনার পর ২০০৯ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার আগে পর্যন্ত তিনি ওই ইনস্টিটিউটে ফরাসি ভাষার সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক ছিলেন।
জাহাঙ্গীর তারেক বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, ইতালিয়ান, আরবি, ফার্সি ভাষা জানতেন। বাংলা থেকে প্রধানত বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষা এবং এসব ভাষা থেকে বাংলায় তিনি নিয়মিত অনুবাদ করতেন বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম ও দলিলপত্র। ফরাসি, স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান ভাষায় তিনি নজরুলের নির্বাচিত কবিতা সংকলন অনুবাদ করেন, যা নজরুল ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত হয়। বাংলায় অনুবাদ করেছেন গুস্তাভ ফ্লবেরের বিখ্যাত উপন্যাস মাদাম বোভারি।
১৯৯২ সালে ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ থেকে প্রকাশিত ৫০ জন ফরাসি ও বাঙালি কবির রচনার অনুবাদগ্রন্থে জাহাঙ্গীর তারেকের অনেকগুলো অনুবাদ রয়েছে। এ বইটির বাংলাদেশ অংশের অনবদ্য ভূমিকাটিও তাঁর রচনা। তিনি বাংলা একাডেমির বাংলা-ইংরেজি ও ইংরেজি-বাংলা অভিধান প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
জাহাঙ্গীর তারেক অধ্যাপনা, অনুবাদকর্ম এবং বিভিন্ন ভাষা চর্চায় তাঁর জীবন অতিবাহিত করে গেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ ও নীরব জ্ঞান সাধনায় নিবেদিতপ্রাণ। তাঁর মতো জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশে বিরল।
আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে আমি বহু গুণী শিক্ষার্থীর সংস্পর্শে এসেছি, যাঁদের মধ্যে অনেকেই সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী। তুলনামূলকভাবে মননশীল প্রতিভার অধিকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম। যার একটা কারণ হয়তো এই যে মননশীল কাজে অধিক পরিশ্রম করতে হয়। যে কারণে বাংলা বিভাগ থেকে মননশীল অপেক্ষা সৃজনশীল প্রতিভা বেরিয়েছে বেশি। যে কজন মননশীল প্রতিভার অধিকারী বাংলা বিভাগ থেকে বেরিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে জাহাঙ্গীর তারেক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এর কারণ হয়তো এই যে তিনি ইংল্যান্ড না আমেরিকায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ না করে ফরাসি দেশে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। ফরাসি দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার একটি বিষয় ছিল বহুভাষাজ্ঞান এবং এমন বিষয় নিয়ে বিদ্যা চর্চা করা। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাহাঙ্গীর তারেক বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া ফরাসি, জার্মানিসহ আরও কয়েকটি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন এবং সেই সব ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু অনুবাদ সম্পাদন করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বাগার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ফরাসি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় একটি ক্ল্যাসিক গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশ। অপরদিকে তিনি কাজী নজরুল ইসলামের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ ফরাসি, স্প্যানিশ ও ইতালিয়ান ভাষায় প্রকাশ করেন, যা এর আগে আর কারও দ্বারা সম্ভবপর হয়নি। তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রি ছিল তুলনামূলক সাহিত্য নিয়ে।
সবচেয়ে যেটি বিস্ময়কর যে জাহাঙ্গীর তারেকের মধ্যে তাঁর এই বিদ্যা, বুদ্ধি ও মনীষা নিয়ে কোনো রকম অহমিকা বা গর্ব ছিল না। তিনি যেহেতু স্বল্প ও মৃদুভাষী ছিলেন এবং তাঁর অধিকাংশ সময় কাটত দেশি–বিদেশি ভাষা ও সাহিত্যচর্চায়, সে কারণে তাঁর যোগ্য সম্মান বা প্রচার তিনি এ দেশে পাননি। জাহাঙ্গীর তারেক আমাদের দেশের একজন ব্যতিক্রমধর্মী পণ্ডিত ও মনীষী ছিলেন।
ড. রফিকুল ইসলাম: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইউল্যাব, ঢাকা৷