মধুমঙ্গলের কাহিনি

রাতের আকাশ থেকে হিমের প্রলেপ মাখা চাদরটা এখন উধাও। মাথার ওপরে ওল্টানো বাটির মতো ঝকঝকে বড় এক আকাশ। সেই আকাশ ভরা চাঁদ। কখনো বাঁকা কাস্তে চাঁদ, কখনো কামড়ে খাওয়া বিস্কুট। কখনো চাঁদ গোল সোনালি টোপাকুল। পূর্ণিমায় সেই চাঁদ খল খল হাসে। হাসি কিষান-কিষানির মুখেও। এবার রবিশস্যের আবাদ ভালো হয়েছে। খেতের আলের ধারে টুকটুকে লাল লঙ্কার স্তূপ; চরের জমিতে সবুজ পাতার ফাঁকে নেমেছে মিষ্টি কুমড়ার ঢল। বিলের অতিথি পাখির ডানায় ঘরে ফেরার শিহরণ। কদিন পরেই ঝাঁক বেঁধে আকাশ পাড়ি দেবে তারা। গেরস্তের শজনে ডালে দখিনা বাতাসের মৃদু কাঁপন। এখন বসন্ত নেমেছে গ্রামবাংলায়।
২৪ বছর পর এক চৈত্র দিনে নিশ্চিন্দিপুরে ফেরার পথে অপুর চোখে পড়েছিল বাংলার বসন্তের রূপ। বিভূতিভূষণের জাদুকরি কলমের দু-একটি আঁচড়ে সেই বসন্তের বর্ণনা অমলিন হয়ে আছে অপরাজিত-এর পাতায়। পূর্ব বাংলার বসন্তের যে একটা নিজস্ব রূপ-রস-গন্ধ ভরা স্বকীয়তা রয়েছে, তা প্রকৃতিপ্রেমী বিভূতিভূষণের নজর এড়ানোর কথা নয়।
জ্যৈষ্ঠ মাসকে প্রচলিত অর্থে মধুমাস বলা হয়। আম, কাঁঠাল, লিচুর মধুর রসের স্রোতে এই শিরোপা আবহমান কাল ধরে চলছে। তবে আভিধানিক অর্থে চৈত্রকে মধুমাস হিসেবে গণ্য করা হয়। আজকাল ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি থেকেই মধু আহরণ করা হয়। গোটা বাংলাদেশে মৌমাছি ও মধুর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি সুন্দরবন, আঞ্চলিক ভাষায় যার নাম বাদাবন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনের প্রায় গাছই ফুল ফোটার সময় এগিয়ে এসেছে; ফাল্গুন মাস থেকেই ফুল ফুটতে শুরু করে এখন। প্রথমে ফোটে গোরান আর খলসে ফুল। তারপর একে একে ফোটে গেওয়া, বাইন, কেওরা ও পশুর ফুল। ফাল্গুন, চৈত্র আর বৈশাখ—এই তিন মাস মধু সংগ্রহের ভরা মৌসুম। মে মাসের পর আর ফুল থাকে না বাদাবনে।
সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জকে অনেকেই নাম দিয়েছেন ‘মধু রেঞ্জ’। অধিকাংশ মহুল ফুলের গাছ এখানেই জন্মে; আর পুরো সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ মধু জোগাড় হয় বুড়িগোয়ালিনী থেকে। গত সিডরে ক্ষতিগ্রস্ত বাদাবনকে বাঁচানোর তাগিদে বনে গাছ কাটা, শিকার বা মধু সংগ্রহ নিষিদ্ধ। মানুষের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ বন্ধ হওয়ায় এবং বিগত কয়েক বছরের সতর্কতার কারণে সুন্দরবন একটু একটু করে আবার আগের রূপ ফিরে পেতে চলেছে।
সুন্দরবনের মধুমঙ্গলকাব্য এখন লিখে চলেছে এই অনুগত পোষা মৌমাছিরা। তবে বনের মৌমাছির চাকের কিছু মধু যে চোরাপথে বাজারে ওঠে না, তা বলা মুশকিল।
সুন্দরবন ছাড়াও ঈশ্বরদী, নাটোর, রাজশাহীর নানা অঞ্চল থেকে আম ও লিচু ফুলের মধু সংগ্রহ করা হয়। নাটোরের বনপাড়া, ঝিনাইদহ, নিতাইনগরে কালোজিরা, ধনিয়া ও তিলফুল থেকে মধু তোলা হয় পোষা মৌমাছি দিয়ে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এসব গাছের ফুলে মধু জমে বেশি। কালোজিরা দেখতে কালো কিন্তু এর ফুল সাদা, মধুর রং হালকা হলদে। বাজারে ভেষজ গুণের জন্য এসব মধুর চাহিদা যথেষ্ট। শিক্ষিত মধু ব্যবসায়ী নয়ন, এলাকায় ‘নয়নমধু’ হিসেবে যাঁর পরিচিতি, তিনি এসব তথ্য দিয়েছেন।
ফাল্গুন-চৈত্র মাসে খাল, বিল, ডোবা, পুকুর থেকে পানি নেমে গেলে গ্রামে গ্রামে পলো, খ্যাপলা জাল দিয়ে মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যায়। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে মাছের ফলন এমনিই কম। দিনভর খাল-বিল হাতড়ে মাছ পাওয়া যায় সামান্য; পানি-কাদায় দাপাদাপিই সার হয়। পাশাপাশি, উপকূলের নদীর মোহনায়, বিশেষ করে পটুয়াখালীতে এখন কাঁকড়া ধরার ধুম। নদীতে এ সময় জাল ফেললেই কাঁকড়া ওঠে। বন্ধ মুখ ঝুড়িতে হাওয়াই জাহাজে করে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে জ্যান্ত কাঁকড়া পাঠানো হয়। সেখানকার হোটেল-রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশের কাঁকড়ার বেজায় চাহিদা। গত বছর বাংলাদেশ পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি কাঁকড়া রপ্তানি করেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি প্রজনন মৌসুম হওয়ায় এ সময় কাঁকড়া ধরায় কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। অসচেতনতার কারণে এ সময় কাঁকড়া ধরা হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে।

২.
রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধেছেন, ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় ফাগুন মাসে’—কী উচ্ছ্বাসে ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা। গাছে ফুল ফোটে আষাঢ় মাসে, ফাল্গুনে নয়। তবে এই গানের ‘পুষ্প বিভোর ফাগুন মাস’ কলিটি মোটেই কবিকল্পনা নয়। এ শুধু বাস্তবই নয়, দর্শনীয় এবং স্পর্শনীয়ও বটে। বাংলাদেশের যশোর, কুষ্টিয়া এবং সম্প্রতি রাজশাহীর উঁচু বরেন্দ্রভূমিতে প্রচুর ফুল চাষ হয়। চুয়াডাঙ্গায় হয় রজনীগন্ধা ফুলের সবচেয়ে বড় আবাদ। পয়লা ফাল্গুন, ভালোবাসার দিন, একুশে ফেব্রুয়ারি, বসন্ত উৎসব সামনে রেখে এই মৌসুমে হাজার হাজার ‘ঝোপা’ ফুল ট্রাকে করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ নানা জেলায় পাঠানো হয়। কালীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এ সময় চোখে পড়ে হলুদ-কমলা রঙের গাঁদা ফুলের সারি সারি বাগান। গ্রামের দুস্থ নারীরা এই ফুলের ‘ঝোপা’ বেঁধে দুটো পয়সার মুখ দেখেন। ৮০০ গাঁদা ফুলের প্রতিটি ঝোপার জন্য ১২ থেকে ১৫ টাকা মজুরি, সারা দিনে কাজ করলে ১৫০ টাকা আয় হয়। পালা-পার্বণ সামনে থাকলে সেই আয় কখনো কখনো ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় ওঠে। গ্রামের গরিব ঘরের স্কুলপড়ুয়া মেয়েরা ছুটির দিনে বা স্কুল বন্ধ হলে ফুল তোলা আর ঝোপা বাঁধায় হাত লাগায়। এসব করে যে কটি টাকা ওদের হাতে আসে, তাই দিয়ে লেখাপড়া আর সংসারের চাকা চালু রাখায় সাহায্য করে বাবা-মাকে। এসব বাগানে প্রায় সারা বছরই ফুল তোলা আর ঝোপা বাঁধার কাজ মেলে।
একদা ঢাকার বাসিন্দা তরুণ বুদ্ধদেব বসু তাঁর দেখা প্রায় ৭০ বছর আগের ঢাকাকে স্মরণ করে লিখেছেন, ‘কোনো চৈত্র মাসের দুপুর বেলায় শাঁখারী বাজারের মধ্য দিয়ে হেঁটেছ কোন দিন? কী আশ্চর্য সেই সরু, ছোট, পুরানো গলিটি, দুদিকে গায়ে গা ঠেকানো তেতালা-চারতালা চক মেলানো বাড়িগুলি, রোদ ঢুকতে পারে না সেই গলিতে। পা দিলেই সোঁদা সোঁদা গন্ধ...শাঁখের করাতে ধারালো আওয়াজ সব সময়। হয়তো দু’শ তিন’শ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে এরা।’
শাঁখারীবাজার এখনো অনেকটা এ রকমই রয়ে গেছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে ঢাকার অনেক রক্ত পলাশ আর তপ্ত শিমুলগাছ। হারিয়ে গেছে সেগুনবাগিচায় প্রেসক্লাবের মোড়ে সেই মহিমান্বিত বিশাল বাগানবিলাসের ফুলে ভরা অপরূপ গাছটি, যার স্মৃতি আজও অনেকের মনে অজর, অক্ষয়, অমর হয়ে আছে। মগবাজার চাররাস্তার কোনায় শণের চালের ছবির মতো একটি সাদা বাংলো ধরনের একতলা বাড়ির কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। বাড়িটি সত্তর দশক পর্যন্ত টিকে ছিল। ‘দি হ্যাপি নুক’ নামের সুখী চেহারার সেই বাড়িটি হারিয়ে গিয়ে এখন শুধুই স্মৃতি। ঘড়ির কাঁটাকে পেছানো যায় না, পেছানো উচিতও নয়। সময় আর প্রগতিকে সব সময়ই পথ ছেড়ে দিতে হয়!
মাহবুব আলম, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও লেখক।