মমতার জয়ের অভিলাষ!

মমতা ব্যানার্জি
মমতা ব্যানার্জি

ভারতের লোকসভা নির্বাচন ঘিরে এখন নতুন স্বপ্নে বিভোর মমতা। মমতা মানে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বেসর্বা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর আশা, এবার হয়তো ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের জবাব দিতে পারবেন। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁর দল পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে পায় মাত্র একটি। সেবার তিনি নির্বাচনী জোট করেছিলেন বিজেপির সঙ্গে। সেবার অবশ্য বামফ্রন্ট ৩৫টি এবং জাতীয় কংগ্রেস ছয়টি আসনে জিতেছিল। এবার সেই ফলাফলের জবাব দিতে চাইছেন মমতা। মমতা চাইছেন ৪২ আসনেই জিতে আসতে। আর এই উদ্দেশ্যে নির্বাচনী মাঠে নামিয়েছেন একঝাঁক তারকা: চলচ্চিত্র থেকে সংগীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী আর শিক্ষাবিদদের, যাঁদের নেই কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। মমতা চাইছেন এঁদের এনে নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে। তাঁর বিশ্বাস, মানুষ এখনো তারকা প্রার্থীদের চাইছে রাজনীতির সঙ্গী করতে। এসব ভাবনা থেকেই মমতার এই তারকাদের মনোনয়ন। লক্ষ্য, সমুচিত জবাব দিতে হবে ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের।
বলা বাহুল্য, ভারতের লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে ৪২টি আসন। এর মধ্যে এখন তৃণমূলের ১৯টি, বামফ্রন্টের ১৫টি, কংগ্রেসের ছয়টি, বিজেপি এবং এসইউসিআইর একটি করে আসন রয়েছে। মমতা এবার চাইছেন পশ্চিমবঙ্গের সব কটি আসন কবজা করে লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে।
সত্যি কি মমতা এবার এই লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের শূন্য করতে পারবেন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, না, এটা অসম্ভব। তা ছাড়া এই নির্বাচন নিয়ে ভারতজুড়ে এযাবৎ যতগুলো জনমত সমীক্ষা হয়েছে, তাতে কোনো জনমত সমীক্ষায় এমন কোথাও আভাস দেওয়া হয়নি যে পশ্চিমবঙ্গ বিরোধীশূন্য হতে চলেছে। ‘মমতাঝড়ে’ সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেলেও অন্তত বহরমপুরের কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর আসনটি ছিনিয়ে নেওয়া তৃণমূলের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা হয়তো তৃণমূলের অন্দরের সবাই জানে। তবু রাজনৈতিক ময়দান গরম রাখার জন্য মমতার এই প্রচারণার বিরাম নেই। এ ছাড়া দার্জিলিংয়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা প্রার্থী দিলে অথবা তারা যদি তৃণমূল বাদে অন্য দলকে সমর্থন জোগায়, সেই আসনটিও ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। তাদের মতে, ৪২টি আসনের মধ্যে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের আসন তো থাকছেই, এমনকি আসন পেতে পারে বিজেপিও। কারণ, এবার লড়াই আর সরাসরি বামফ্রন্টের সঙ্গে নেই। এবারের লড়াইয়ে তৃণমূলের সঙ্গী নেই জাতীয় কংগ্রেস বা বিজেপি। লড়াই হচ্ছে ত্রিমুখী আর চতুর্মুখী এবং তাতে যে বামফ্রন্ট বেশি সুবিধা পাবে, সেটা নিশ্চিত রাজনৈতিক মহল। তাই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, লড়াই যত বেশিমুখী হবে, তত ফলাফল ভালো করে বসতে পারে বামফ্রন্ট। কারণ, বামফ্রন্টের এখনো একটা নির্দিষ্টসংখ্যক ভোট আছে। আছে নিজস্ব ভোটব্যাংক। ভাসমান ভোট তাদের কম।
এবারের হিসাব বলছে, মমতার ভোটের একটা অংশ চলে যাবে বিজেপির দিকে। কারণ, কমিউনিস্টবিরোধীদের অনেকে বরাবরই ভোট দিতেন মমতা এবং কংগ্রেসকে। এবার সেই ভোটটা চলে যেতে পারে বিজেপির থলেতে। যদিও মমতা এসব যুক্তি মানতে রাজি নন। তাঁর কথা, এখনো মানুষ মুখিয়ে আছে তাঁর প্রতি, তাঁর দলের প্রতি। মানুষ আর চাইছে না সিপিএম, কংগ্রেস আর বিজেপিকে। সবাই তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাই তিনি জিতবেন।
বিরোধী দলের নামী প্রার্থীদের ঘায়েল করতে মমতা এবার নির্বাচনী আসরের অস্ত্র করেছেন তারকা প্রার্থীদের। যেমন কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীকে ঘায়েল করতে নামিয়েছেন সংগীতশিল্পী ইন্দ্রনীল সেনকে। ইন্দ্রনীল তো বলেই দিয়েছেন তাঁর জয় নিশ্চিত। ২০০ ভাগ নিশ্চিত।
কিন্তু আসলে কি তাই হবে? প্রশ্ন খোদ রাজনীতিক মহলে! বামফ্রন্টের নয়বারের সাংসদ বাসুদেব আচারিয়াকে ঘায়েল করতে নামিয়েছেন অভিনেত্রী মুনমুন সেনকে, সিপিআইয়ের বর্তমান সাংসদ প্রবোধ পান্ডার বিরুদ্ধে নামিয়েছেন অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়কে, বামফ্রন্ট প্রার্থী মহম্মদ সেলিম এবং কংগ্রেস প্রার্থী দীপা দাসমুন্সীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন দীপার দেবর সত্যরঞ্জন দাসমুন্সীকে, রাষ্ট্রপতির ছেলে কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ মুখার্জির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন সাবেক বিচারপতি ও মন্ত্রী হাজি নুরুল ইসলামকে, বিজেপি প্রার্থী ও সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যব্রত মুখোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নামিয়েছেন অভিনেতা তাপস পালকে। এভাবে তাঁরা বিরোধী প্রার্থীদের ঘায়েল করার জন্য আরও দাঁড় করিয়েছেন অভিনেত্রী শতাব্দী রায়, সংগীতশিল্পী সৌমিত্র রায়, নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও নেতাজির নাতি অধ্যাপক সুগত বসুসহ নায়ক দেবকে।
মমতা এবার এসব তারকা প্রার্থী দাঁড় করিয়ে মাত করতে চাইছেন লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বাজারকে। পারবেন কি তিনি? এখন শুধু অপেক্ষা নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফলের দিন পর্যন্ত। পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের লোকসভা নির্বাচন ১৭, ২৪, ৩০ এপ্রিল এবং ৭ ও ১২ মে। আর ফলাফল ঘোষণা ১৬ মে। এখন শুধু প্রহর গুনতে হবে ১৬ মে পর্যন্ত। তারপর সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে নেই।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।