মহামান্য রাষ্ট্রপতি দুদককে বাঁচান

দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বাঁচাতে মহামান্য রাষ্ট্রপতিই এখন শেষ ভরসা। রাষ্ট্রপতির প্রতি অনুরোধ, সদ্য পাস হওয়া দুদক (সংশোধনী) আইন, ২০১৩ পুনর্বিবেচনার জন্য বিলটি ফেরত পাঠিয়ে দুদককে বাঁচান, যাতে দুদক নামক প্রতিষ্ঠানটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। কারণ, সংশোধনী আইনটি দুদকের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। এ সংশোধনী দুদককে পঙ্গু করে দিয়েছে। সংশোধনী আইন অনুযায়ী জজ, ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭-এর বিধান আবশ্যিকভাবে পালন করতে হবে।

সংশোধনী আইনের ১১ ধারায় ৩২ক নামে একটি নতুন ধারা সংযোজন করে সংশোধনীটি পাস হয়েছে। ৩২ক শুধু দুদক আইনের ধারা ৩২-এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলিরও পরিপন্থী। সরকারি কর্মচারীর বাইরে সাধারণ নাগরিকই কেন একই ধরনের আইনি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে?

নতুন সংশোধনী স্পষ্টতই সংবিধানের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে বলা হয়েছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩২ক ধারা পাস হওয়ায় দেশবাসী হতাশ। গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন দেশের সব নাগরিকদের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য হতে হবে। অথচ মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে পূর্বানুমোদনের বিধান রেখে সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।

আইনি প্রলেপ দিয়ে দুদককে পঙ্গু বানানো হলো। বর্তমানে দুদকে বিপুল পরিমাণ মামলা অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে, যার অধিকাংশই মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত এবং যার সঙ্গে বহুসংখ্যক ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী (সরকারি-বেসরকারি) জড়িত। সংশোধিত আইন অনুযায়ী তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৭ ধারার বিধান আবশ্যিকভাবে প্রতিপালন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে অনুসন্ধান, মামলা দায়ের, তদন্ত, মামলা পরিচালনা—সবকিছুই ভেস্তে যেতে পারে। এ ছাড়া সংশোধিত আইনটি রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মচারীদের গোপন আঁতাতের সুযোগ সৃষ্টি করে দুর্নীতির পথ আরও প্রশস্ত করবে।

সংশোধনীর মাধ্যমে স্বশাসিত সংস্থাটিকে সরকারের আওতাভুক্ত করা হলো। আইনটি সংশোধনের ক্ষেত্রে আইন মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়েছে। তারা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা না দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। দুর্নীতি দমনসংক্রান্ত বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অভিজ্ঞতা আহরণের জন্য সংসদীয় কমিটি অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সফর করে। অথচ ওই দেশগুলোর আইন-বিধি খতিয়ে দেখার যে অভিজ্ঞতা, তা অগ্রাহ্য করেই সংশোধনীটি পাস করা হলো। তাহলে রাষ্ট্রীয় অর্থ খরচ করে এসব সফরের প্রয়োজন কী ছিল? দুদক তার এখতিয়ার হরণ করে আগের ঠুঁটো জগন্নাথ ব্যুরোতে পরিণত হতে চায়নি।

সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা দুর্নীতির প্রতিকার। প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দুদকের পর্যাপ্ত ক্ষমতা থাকাটা জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক যে, এই সংশোধনীতে সাধারণ মানুষের সেই দুর্বিনীত আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষিত হলো। কেবল সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যদি দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করতে কর্তৃপক্ষের অনুমতির প্রয়োজন হয়, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী কিংবা অন্যান্য পেশাজীবী কী দোষ করেছেন?

সরকারি কর্মচারীর বাইরে সাধারণ নাগরিকই কেন একই ধরনের আইনি সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে? এর ফলে দুদকের আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলেও পূর্বানুমতি লাগত। এখন সেই বিধানই প্রবর্তন করা হলো। তাহলে ব্যুরো আর কমিশনের মধ্যে পার্থক্য থাকল কোথায়?

দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন-সহযোগীরাও এমন সংশোধনীর ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। বস্তুত বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি ও সমালোচনার মুখেই ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংসদে উত্থাপিত বিলটি আড়াই বছর আটকে ছিল। বিস্ময়কর হচ্ছে, সরকারের অর্থমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী, এমনকি আইনমন্ত্রীর মতামতও আলোচ্য সংশোধনীতে উপেক্ষা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুদককে আরও শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ক্ষমতায় আসার পর মূলত সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নেই দুদক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু সেই শুভযাত্রার এমন অশুভ গন্তব্য!

বিশ্বের সর্বত্র রাষ্ট্রীয় লুটপাটের ঘটনায় ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’দের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে। তাই তাঁদের কাজের বিষয়ে অধিকতর জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকারি বিভাগে কাজ করলেই যদি ‘সুরক্ষিত’ থাকেন, তবে বেসরকারি কর্মচারীরা কেন ‘অরক্ষিত’ হবেন? আইনের ক্ষেত্রে এ বৈষম্য চলতে পারে না।

বস্তুত আইনটি সংশোধন করে দুদককে একটি নামসর্বস্ব নির্জীব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হলো। জনগণের সামনে নতুন করে ম্যান্ডেট চাইতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে সরকারি চাকরিজীবীদের পুরস্কৃত করা হলো। এখন দুর্নীতির যারা মাথা, তারা নিজেদের আরও নিরাপদ ভাববে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলাদেশে উন্নয়নের প্রধান অন্তরায় হলো দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতির অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র সরকারি প্রশাসন। সরকারি বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি এখন অপ্রতিরোধ্যভাবে বিস্তার লাভ করেছে। দেশের যেকোনো পর্যায়ে দুর্নীতির জন্য রাজনীতিবিদদের ঢালাওভাবে দায়ী করা হলেও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতির জাল বিস্তার ছড়িয়ে আছে, তার মূলে রয়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

কাজেই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জনস্বার্থে মাননীয় রাষ্ট্রপতির প্রতি বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করছি। বাংলাদেশ সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে এই এখতিয়ার দিয়েছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতি অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান। তাই তাঁর দিক থেকে এখন জনস্বার্থে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে একটি নতুন নজির স্থাপন করা। রাষ্ট্রপতির ভাবমূর্তি এবং তাঁর পদের মর্যাদা সমুন্নত হোক।
মো. খুরশীদ আলম খান: দুর্নীতি দমন কমিশনের প্যানেল আইনজীবী এবং সম্পাদক, ডিএলআর।