মাছ, মিষ্টি ও ক্রেতার স্বার্থ নিয়ে দু–চার কথা

ইলিশ মাছ
ফাইল ছবি

আদ্যবর্ণের মিলটুকু ছাড়া মাছ ও মিষ্টির মধ্যে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সম্ভবত নেই। তবু কেন এই লেখার ভাবনা, তা ক্রমশ প্রকাশ্য। শুরুতে বরং থাক বাংলাদেশের চমকপ্রদ সাফল্যের সাতকাহন।

প্রতিবছর বর্ষায় বাঙালির রসনা ও মন কেন যেন ‘রজতবর্ণ মনোহরদর্শন মৎস্যকুলরাজ’ ইলিশময় হয়ে ওঠে। আমার মতো যারা পশ্চিমের বাঙালি, চাতক পাখির মতো তারা চেয়ে থাকে পুবপানে। বাংলাদেশের কৃপাভিক্ষা কামনা ছাড়া এই সময়টায় আমাদের কিছুই প্রায় করার নেই। যে ‘অ্যাকশন প্ল্যান’ বাংলাদেশে ইলিশ-বিপ্লব সফল করেছে, তার ধারকাছ দিয়েও পশ্চিমবঙ্গ এখনো হাঁটতে পারেনি।

ইলিশ লালনে প্রয়োজন ভালোবাসা, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইচ্ছাশক্তি এবং জন–আন্দোলন। বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে। দুই দশক আগে বাংলাদেশে ইলিশের বার্ষিক উৎপাদন দুই লাখ টনের নিচে নেমে গিয়েছিল। আজ সাড়ে পাঁচ লাখ টন টপকে গেছে! পশ্চিমবঙ্গের কেউ বাংলাদেশের মতো একগুঁয়ে মনোভাব নিয়ে জলের রুপালি শস্য সংরক্ষণের পথে হাঁটতে চায়নি। ‘চায়নি’ শব্দটা ভেবেচিন্তেই লিখলাম। কেননা, ‘চাইলে’ পঙ্গুও গিরি লঙ্ঘায়!

গত বছর ভারত সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের এই চমকপ্রদ সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। বাংলাদেশ হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে তাঁকে বলেছিলাম, ‘আপনারা দুর্দান্ত সফল। আপনারা পেরেছেন। আমরা এখনো পারিনি। ইলিশের ক্ষেত্রে আপনারা দাতা, আমরা গ্রহীতা।’ উনি প্রসন্ন হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনারাও আমাদের দেখানো রাস্তায় হাঁটুন। অবশ্যই সফল হবেন। ইলিশ অবলুপ্ত হলে বাঙালি গর্বিত থাকতে পারবে না।’

সেই গর্ব ও প্রচ্ছন্ন অহংবোধের ছবি দেখি ইউটিউবের কল্যাণে। বাংলাদেশ থেকে গন্ডা গন্ডা ভিডিও প্রতিদিন আপলোড হয়। পাইকার ও খুচরা বিক্রেতা কী দামে কোন মানের ইলিশ বিক্রি করছেন, ইলিশের ওজন, তা চাঁদপুর না বরিশালের, পদ্মার না মেঘনার, বিক্রেতার ফোন নম্বর সব তথ্য নিত্য হাজির! অবাক হয়ে দেখছি, দেড় কেজি ইলিশের খুচরা দাম কেউ এক হাজার টাকা হাঁকলে ক্রেতা অন্য ব্যাপারীর ঝাঁকার দিকে ঝুঁকছে! প্রাচুর্য কোন ধরনের সমস্যা আবাহন করে বাংলাদেশের ইলিশ-বিপ্লব তার নবতম নমুনা।

পশ্চিমবঙ্গকে শেখ হাসিনার এ বছরের পুজো উপহার দেড় হাজার টন ইলিশ। রাজ্যের বাজারের নতুন জৌলুশ। দাম কেজিপ্রতি মিনিমাম দেড় হাজার। এত দামে ইলিশ খাওয়ার রেস্ত কত বাঙালির আছে, সে ভিন্ন বিষয়। এই বাস্তবাতিকতা ভারতে ক্রেতার স্বার্থে যে ব্যবস্থা, রীতি ও পরম্পরা ধারাবাহিকভাবে চালু করেছে, বাংলাদেশে আজও তা সম্ভব হয়নি! কেন হয়নি, কী কারণে, কোন আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও মানসিকতার দরুন, সেই বিশদ ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলা যায়, ক্রেতা বা উপভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষা–সম্পর্কিত আন্দোলন ভারতে যেভাবে শক্তি বৃদ্ধি করেছে, বাংলাদেশে তা হয়নি। অথচ অবশ্যই তা হওয়া উচিত। অন্তত গরিব, সাধারণ, প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে।

আমার সাংবাদিক পিতা বলতেন, ‘হাটে-বাজারে না ঘুরলে, ট্রামে-বাসে না চড়লে, ভিড়ে না মিশলে মানুষের নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যায় না। সাংবাদিকের ওই স্পন্দন পাওয়া জরুরি।’ বলতেন, ‘মানুষ ভালো আছে না কষ্টে সেই প্রতিফলন ঘটে বাজারে।’ আট বছর ধরে বাংলাদেশ আমার ‘সেকেন্ড হোম’। কারওয়ান বাজারে নিয়ম করে ঢুঁ মারি। ক্রেতা-বিক্রেতার কথোপকথন শুনি। দেশের বাজারের সঙ্গে তুলনা করি পণ্যের দামের, মানের, বৈচিত্র্যের। কত মাছ। কত সবজি। কত ফল। কত অভিব্যক্তি। বড় ভালো লাগে দেখতে।

বিস্ময়ও ঝরে। এক মাটি, এক জল-হাওয়া, এক খাদ্যাভ্যাস, তবু দুই দেশের বাজারি রীতি কত আলাদা! আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ক্ষমতা ও প্রয়োজন অনুযায়ী বড় মাছ থেকে কেটে কিছুটা কিনতে পারে। সেই অধিকার রাষ্ট্র ও বাজারের রীতি তাকে দিয়েছে। অথচ বাংলাদেশের নিম্নবিত্ত তা পারে না। চার–পাঁচ কেজির রুই-কাতলা-বোয়াল-চিতল অথবা দেড়-দুই কেজির মায়াবী মোহময়ী ইলিশ দেখে বাংলাদেশের দরিদ্র নিম্নবিত্তের দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্য ও বাজারের রীতি তাকে বড় মাছের অংশবিশেষ কেনার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। বাংলাদেশের বাজারে দরিদ্রের এই করুণ দৃষ্টি আমায় পীড়া দেয়। দরিদ্র ক্রেতাদের যে অধিকার ভারত দিয়েছে, বাংলাদেশ কেন তা থেকে এখনো বহু যোজন দূরে তা ভাবি! উত্তর পাই না।

মাছের সঙ্গে মিষ্টি এমনিতে সম্পর্কহীন। কিন্তু ক্রেতা বা উপভোক্তার অধিকার সুরক্ষা ও ন্যায়-অন্যায় প্রসঙ্গ সেই সম্পর্ক প্রকট করেছে। ঢাকার অভিজ্ঞতা শোনাই।

দাওয়াত রক্ষার আগে এক নামকরা মিষ্টির দোকানে ঢুকেছি। রূপ দেখে যেটা পছন্দ হলো তার কেজি ৯০০ টাকা। এক কেজি দিতে বললাম। দোকানি একটা বাক্সে মিষ্টি ওজন করে বলল, ‘এক কেজি। আর কিছু লাগবে?’ এরপর আমাদের কথোপকথন ছিল এই ধরনের।

‘ভাই, আমি তো এক কেজি মিষ্টি চেয়েছি।’

দোকানি বলল, ‘এক কেজিই তো দিয়েছি! ওজন দেখুন।’

‘জি। তা দিয়েছেন। কিন্তু বাক্সসমেত। বাক্সের ওজন অন্তত দুই শ গ্রাম। তার মানে মিষ্টি আট শ গ্রাম!’

দোকানি বলল, ‘বাক্স ছাড়া দেব কী করে?’ আমি বললাম, ‘বাক্সেই দেবেন। বাক্সের দাম হয় মিষ্টির দামের মধ্যে ধরা থাকবে নতুবা আলাদাভাবে দশ-বিশ টাকা নেবেন। বাক্সের কেজি তো নয় শ টাকা হতে পারে না!’

দোকানি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। আমি তাকে বললাম, ‘ভাই, আমাদের দেশ হলে এই মিষ্টির প্যাকেটের ওজন হতো এক কেজি দুই শ। দুই শ গ্রাম প্যাকেটের ওজন। প্যাকেটের ওজন বাদ দিতে বিক্রেতা বাধ্য। এটা ক্রেতার অধিকার ও ন্যায়ের প্রশ্ন।’

দোকানির প্রশ্ন ছিল, ‘মিষ্টি কি আপনি নেবেন?’ আমার উত্তর, ‘মিষ্টি যদি এক কেজি পাই। কিনতেই তো এসেছি।’

দোকানি রাজি হয়নি। আমিও কিনিনি।

ভারতে উপভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষায় খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটির’ সাম্প্রতিক নির্দেশ, মিষ্টান্ন বিক্রেতাদের মিষ্টির মেয়াদ জানাতে হবে। ‘প্যাকেজড ফুড’-এ যেমন লেখা থাকে। এই সিদ্ধান্তে সমস্যা, ক্ষোভ ও জটিলতা কাটানোর চেষ্টা চলছে। সমাধান সূত্রের খোঁজ চলছে। বিক্রেতার কাছে ক্রেতাই তো লক্ষ্মী!

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় :প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি