মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যে বাংলাদেশি আধুনিকতা

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্য দুনিয়ায় বাংলাদেশের নাম রেখে গেছেন। ছবি: প্রথম আলো
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম স্থাপত্য দুনিয়ায় বাংলাদেশের নাম রেখে গেছেন। ছবি: প্রথম আলো

১৯৯৭ সালের ১৫ অগাস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্থাপত্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলো। শিরোনাম ‘স্বাধীনতার স্থাপত্য: আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার নির্মাণ’। সেখানে উপস্থাপন করা হলো এ অঞ্চলের কয়েকজন সেরা স্থপতির কাজ—ভারতের চার্লস কোরিয়া, বালকৃষ্ণ দোশি, অচ্ছুৎ কানভিন্দে এবং বাংলাদেশের মাজহারুল ইসলাম। প্রদর্শনীটি পরে নিউইয়র্ক , পিটসবার্গ, শিকাগো ও বোস্টন শহর ভ্রমণ করে।

যুক্তরাষ্ট্রে বোধ করি প্রথমবারের মতো এমন একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়, যা আধুনিক স্থাপত্যের নতুন একটি পথরেখা উদ্ভাসিত করে তোলে। কোরিয়া, দোশি ও কানভিন্দে পাশ্চাত্য জগতে অনেকটাই পরিচিত ছিলেন। সেই তুলনায় মাজহারুল ইসলাম তেমন পরিচিত নন। এই অপরিচয় যতটা না কাজের জন্য, তার চেয়ে বেশি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সমসাময়িক বিশ্ব-স্থাপত্য অঙ্গন থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্নতার কারণে। এই চার স্থপতিই দেশের বাইরে স্থাপত্যের শিক্ষা নিয়েছেন। দোশি ছাড়া বাকি সবাই যুক্তরাষ্ট্রে।

প্রসঙ্গত বলতে হয়, একই বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত হয় ‘পুণ্ড্রনগর থেকে শেরেবাংলা নগর: বাংলাদেশের স্থাপত্য’ শিরোনামে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনীতে প্রথমবারের মতো খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে বিশ শতক পর্যন্ত কালক্রমে ভাগ করে ড্রইং, আলোকচিত্র ও লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-নিদর্শন পরিবেশন করা হয়। কালক্রমের শেষ ভাগটি ছিল ‘আধুনিক কাল’। এ অংশে অন্তর্ভুক্ত হয় মাজহারুল ইসলাম ও লুইস কানের স্থাপত্য। এ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছিল দেশের সাধারণ মানুষ ও পণ্ডিতদের সামনে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ স্থাপত্যের ঐতিহ্য তুলে ধরা। ১৯৯৭ সাল ছিল ইংরেজ উপনিবেশ অবসানের ৫০তম বার্ষিকী। সময়টা ছিল দেশি ঐতিহ্য পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের কৌশল নির্ধারণের জন্য উপযুক্ত একটি সময়। প্রদর্শনীটির উদ্দেশ্য ছিল যুগপৎ অতীতের সঙ্গে যোগ স্থাপন এবং ভবিষ্যতের পথ সন্ধান।

বাংলাদেশের স্থাপত্যের ইতিহাসে মাজহারুল ইসলামের স্থান অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ। ঔপনিবেশিক শাসন-উত্তর সময়কালে এ দেশে স্থাপত্যের সূচনা এবং পর্যায়ক্রমে এর প্রতিষ্ঠার পেছনে মাজহারুল ইসলামের অবদান অপরিসীম। আর সেটি ছাপিয়ে আছে স্থাপত্যকর্ম, পেশা ও শিক্ষার পুরো অঙ্গন। স্থাপত্য অঙ্গনে তাঁর পদচারণ প্রায় ছয় দশক জুড়ে। তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্থাপত্য পেয়েছে এক নতুন দিকনির্দেশনা। ১৯৫০-এর দশকের গোড়াতেই দুটি কাজের মাধ্যমে তিনি এর সূচনা করেছিলেন—ঢাকার চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে ফ্যাকাল্টি অব ফাইন আর্টস) এবং গণগ্রন্থাগার (বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার)। তাঁর সর্বশেষ স্থাপত্যকর্ম পর্যন্ত এই দিকনির্দেশনা দেওয়ার কাজটি তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন।

মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যকর্মগুলো বাংলাদেশের ভূগোল, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির পটে সুচিন্তিত বিবেচনার প্রকাশ। উপনিবেশ-উত্তর পরিবেশে এ জাতীয় আধুনিক ভাবনা-আশ্রিত স্থাপত্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছিল অত্যন্ত দুরূহ। সেই দুরূহ কাজটিই দৃঢ়ভাবে এগিয়ে নিয়ে যান তিনি।

মাজহারুল ইসলামের কাজগুলো শুধু ঐতিহাসিকভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ নয়; স্থাপত্য-ভাবনারও অতি গুরুত্বপূর্ণ ভান্ডার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্থপতিদের শেখার ও অনুপ্রেরণা নেওয়ার অমূল্য উৎস। ১৯৫০-এর দশকের শুরুতে মাজহারুল ইসলাম যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপত্যে শিক্ষা শেষে দেশে ফিরে এসে আসেন। এসে স্থপতির পেশা বরণ করেন। তাঁর প্রথম দিকের কাজে পশ্চিমের সমকালীন স্থাপত্যের, বিশেষ করে দুই আধুনিক স্থাপত্যগুরু লে কর্বুসিয়্যে এবং আলভার আলতোর প্রভাব দেখা যায়। পশ্চিমা আধুনিকতাবাদে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মোটেই তার অনুকরণ করেননি। তাঁর কাজ ছিল আধুনিক ধ্যানধারণার বিচক্ষণ বিশ্লেষণ এবং তার সঙ্গে দেশজ অভিজ্ঞতা ও উপাদানের এক সুচিন্তিত সংশ্লেষ। এই সংশ্লেষণের ধারণার ভিত্তিতে তিনি আরও পরিণত স্থাপত্য রচনায় মগ্ন হন।

১৯৬০-এর দশকের শুরুতে মাজহারুল ইসলাম দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে যান। জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি আজীবনের বন্ধুত্বের সূত্রপাত ঘটে সহপাঠী মার্কিন স্থপতি স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে দেশে ফিরে তিনি নতুন উদ্যমে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬০-এর দশক মাজহারুল ইসলামের সৃজনশীলতার এক উর্বর সময়। এ সময়ে তিনি একের পর এক তাৎপর্যপূর্ণ ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যকর্ম রচনা করেন।

মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যকর্ম ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে। চারু ও কারু মহাবিদ্যালয় এবং গণগ্রন্থাগার ছাড়াও ঢাকায় তাঁর স্থাপত্যকর্মের মধ্যে আছে বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার, জাতীয় জনপ্রশাসন ইনস্টিটিউট, সড়ক গবেষণাগার, কৃষি ভবন, ইস্টার্ন ফেডারেল ইনস্যুরেন্স ভবন। ঢাকার বাইরে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা ও বিভিন্ন ভবন, রূপপুর আণবিক শক্তি কেন্দ্রের আবাসিক এলাকা এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাপরিকল্পনা ও কয়েকটি ভবন উল্লেখযোগ্য। বন্ধু স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে যৌথভাবে রচনা করেছেন রংপুর, বগুড়া, পাবনা, সিলেট ও বরিশালে পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। প্রতিটি কাজেই তিনি বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি, জলবায়ু, নির্মাণ উপকরণ ও সমাজ বিবেচনায় নিয়ে এবং বিশ্লেষণ করে সমাধানে পৌঁছেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৃহদায়তন পরিকল্পনার একটি স্পষ্ট ধারণা তিনি রেখে গেছেন। এসবের সুচিন্তিত নজির রয়ে গেছে তাঁর শেষ দিকের কাজগুলোতে।

মাজহারুল ইসলাম কেবল নিজের কথা ভাবেননি। দেশের স্থাপত্য-সংস্কৃতির উৎকর্ষে বিশ্বখ্যাত স্থপতি লুইস কান এবং তাঁর শিক্ষক পল রুডলফকে বাংলাদেশে কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। তাঁর সার্বক্ষণিক ভাবনায় ছিল বাংলাদেশের স্থাপত্যের উত্তরোত্তর উন্নতি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর ব্যক্তিজীবন ও পেশাজীবন দুটোই মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। ধীরে ধীরে তিনি কর্মহীন জীবনের দিকে ধাবিত হন। দেশ ও জাতি এই মেধাবী স্থপতির অবদান থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে শুধু দুটো প্রকল্পে তিনি কাজ করতে পেরেছিলেন—জাতীয় গ্রন্থাগার এবং জয়পুরহাট খনি-নগরী।

প্রথম প্রকল্পটির সময় জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভস ভবন সমন্বিতভাবে নকশা করা হয়, কিন্তু পরে সেটি শেষ হয় আর্কাইভস ভবন বাদ দিয়ে। এর বাস্তবায়নেও সরকারি নির্মাণ দপ্তরের শোচনীয় অবহেলা ছিল। আর খনি-নগরীটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতে থাকতে ব্যবহারের আগেই জীর্ণ হয়ে পড়ে।

২০১৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরের সুইস স্থাপত্য জাদুঘরে ‘বেঙ্গল স্ট্রিম’ নামে বাংলাদেশের স্থাপত্য নিয়ে ছয় মাসব্যাপী একটি বড় প্রদর্শনী হয়। এর আগে দেশের বাইরে এত বড় আয়তনে বাংলাদেশের কোনো প্রদর্শনী হয়নি। এই প্রদর্শনীর একটি বড় আকর্ষণ ছিল মাজহারুল ইসলামের কাজ। দর্শকদের মধ্যে তাঁর কাজ ব্যাপক সাড়া জাগায়। অর্ধশতক আগেই যে বাংলাদেশে এত উঁচু স্তরের স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল, সে ছিল তাদের ধারণার বাইরে। প্রদর্শনীটি পরে ফ্রান্সের বোর্দো ও জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে গিয়েও আলোড়ন তোলে। বড় পরিসরে ইউরোপের মাটিতে বাংলাদেশের স্থাপত্যের সেই প্রথম প্রদর্শনীটি ছিল দেশি স্থাপত্যের এক বড় স্বীকৃতি।

মাজহারুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই তিনি গত হন। তাঁর প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে ছয় দশকের বেশি সময়ের একটি নান্দনিক কর্মমুখর জীবনের। বাংলাদেশের নবীন প্রজন্মের কাছে এই মহান স্থপতির কাজ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ব্যাপক। তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নেওয়ার বিষয়ও প্রচুর। কিন্তু দুঃখজনকভাবে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে তাঁর অমূল্য কাজগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, তাঁর বেশ কিছু কাজের অসংবেদনশীল ও অনান্দনিক পরিবর্তন ও ধ্বংসসাধন করা হয়েছে। মাজহারুল ইসলাম এখন আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অংশ। তাই এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের জনকের কাজের প্রতি এই অবহেলার দ্রুত অবসান ঘটানো দরকার। জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ না নিলে এটি দুঃসাধ্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশের এই কৃতী সন্তানের কাজের যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ অনতিবিলম্বে নেওয়া কর্তব্য। এই বিষয়ে কালক্ষেপণ করলে তাঁর স্থাপত্যকর্মগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বঞ্চিত হবে।

সাইফ উল হক: ঢাকায় কর্মরত স্থপতি।